×

প্রবাস

‘আমি একজন গ্রামের ছেলে’ পরিচয়েই গর্বিত

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৩ পিএম

‘আমি একজন গ্রামের ছেলে’ পরিচয়েই গর্বিত

রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন

আমি একজন গ্রামের ছেলে। কাদামাটির পথ পেরিয়ে, ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, হারিকেনের আলোয় বই পড়ে বড় হয়েছি। গ্রামের স্কুলে কয়েক বছর, তারপর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শহরের এক স্কুলে, এরপর ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (DRMC)—এইভাবেই আমার শিক্ষার পথচলা। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে পাড়ি জমাই সুদূর সুইডেনে। তখনও বুঝিনি, জীবনের সবচেয়ে সহজ প্রশ্নগুলো কাউকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, আর সত্য কথা বলাও কখন যেন দোষের হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলা ভাষা আমি শিখেছি গ্রামে—মায়ের মুখে, মাটির গন্ধে। উচ্চারণ হয়তো শহুরে নয়, কিন্তু হৃদয়ভরা। অনেকের কাছে এই ভাষা ‘ভাঙা’ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই ভাঙা ভাষাতেই আমি লিখে যাচ্ছি বিগত দশ বছর ধরে। আমি জানি, শব্দে শুধু ব্যাকরণ নয়, হৃদয়ের সত্তাও লাগে। আমার ভাষা কাগজের জন্য নয়, জীবনের জন্য।

আজ আমি বিশ্বের শীর্ষ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একজন পরিচালক। এটি কোনো একদিনের ঘটনা নয়—তিন দশকের শ্রম, অধ্যবসায়, বৈশ্বিক প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনার নানা স্তরে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং ব্যর্থতার মুখে অটল থাকার সাধনা এই পরিচয়ের পেছনে আছে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও, হঠাৎ দুইদিন আগে আমার দেশ পত্রিকার এক সাংবাদিক ভাই টেলিফোনে বললেন, “আপনি তো তেমন ভালো লেখক না। আমি তো আপনার থেকেও অনেক ভালো মানের—বড় বড় প্রফেসরদের লেখাও ঠিক করে দেই। এমনকি সজিবদের লেখাও না করে দেই। আর আপনি তো…!” তিনি জানতে চাইলেন, আমার পড়াশোনা কী? প্রতিদিন কীভাবে লিখি? এআই-এর সাহায্য নিই কিনা? প্রশ্ন করে গেলেন কিন্তু শোনার মতো সময় তাঁর ছিল না।

সুযোগ পেলে বলতাম—আমার বন্ধুরা কেউ বুয়েটের নামকরা প্রফেসর, কেউ সিনিয়র সজিব, কেউ জেনারেল, কেউবা আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত। আমি নিজেও একজন পরিচালক—প্রডাকশন ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বিশ্বের বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু পাশ্চাত্যে এসব গৌরবের কথা কেউ শুনতে চায় না, বোঝেও না পেছনের লড়াইয়ের ইতিহাস। কেউ জানতে চায় না আমার বাবা-মা কে ছিলেন বা কী করেছিলেন। এখানে শুধু দেখা হয়—এই মুহূর্তে আপনি কী করছেন, আপনার আসিভমেন্ট এবং অ্যাসাইনমেন্ট কী?

তবুও তিনি আমাকে শুনিয়ে দিলেন অনেক কিছু। বাংলাদেশে আজ পরিচয় ছাড়া, টাইটেল ছাড়া, বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে থেকে কিছু করতে গেলে—তা যেন অসম্ভব। আপনি কী লিখলেন, সেটা বড় কথা নয়; আপনি কে লিখলেন—সেটাই মুখ্য। আর তাই এ দেশে দিন দিন ‘আম’ আর ‘ছালা’ দুটোই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

হতে পারে, এই লেখাটি পড়ে সেই সাংবাদিক ভাই আর আমার লেখা ছাপাবেন না। কিছু যায় আসে না তবুও, আমি লিখব। কারণ আমি নিজে যেটা ভালো মনে করি এবং জানি সেটাই বলি এবং সেটাই লিখি।

আমার মতো যারা প্রবাসে আছে, তাদের প্রায় ১০০ ভাগই এই একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আপনি চাইলে নিচের কিছু লাইন পড়ে, যে কোনো একজন প্রবাসী বাংলাদেশিকে জিজ্ঞেস করুন—তাদের মুখেই আপনি আমার এই একই ধরনের কথা শুনবেন।

আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আমরা বুঝতে পারি— প্রবাসে থাকা প্রতিটি বাঙালি আসলে এক একটি জীবন্ত বারুদ।

বাঙালি যে এক একটি জীবন্ত বারুদ—অর্থাৎ শক্তি, সম্ভাবনা ও বিস্ফোরণের জাতি, সেটা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী বাঙালিদের দিকে তাকাতে হবে। তাকাতে হবে আমার মতো মানুষের দিকে, যিনি গ্রামের কাদামাটি পেরিয়ে আজ সুইডেনের মতো উন্নত রাষ্ট্রে অবস্থান করছেন; জানতে হবে আমার মতো লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, আর সফলতার গল্প—যা বলা হয় না, লেখা হয় না, তবুও নিঃশব্দে ইতিহাস হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে থেকে আমরা নিয়ম ভাঙি, দায়িত্ব এড়িয়ে যাই, অনেক সময় কাজ ফাঁকি দেই। অথচ বিদেশে গিয়েই সেই একই মানুষটি নিয়ম মানে, সময় মেনে চলে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। কেন?

কারণ সে জানে—এখানে চাটুকারিতায় কাজ হয় না, এখানে নাম বা পরিচয়ে চাকরি মেলে না, এখানে যোগ্যতা ছাড়া মূল্য নেই।

এই প্রবাসী বাঙালিরা মাসে মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালন সচল রেখেছে। এর পেছনে আছে অমানুষিক শ্রম, সীমাহীন ত্যাগ, এবং এক ধরনের নিঃশব্দ দায়বোধ—দেশের প্রতি, মাটির প্রতি, মানুষজনের প্রতি। প্রবাসে থেকেও তারা দেশকে বুকে আগলে রেখেছে।

কিন্তু এই পরিবর্তনের মূল কারণ কী?

কারণ প্রবাসে বিচার-ব্যবস্থা কাজ করে, রাষ্ট্র দাঁড়ায় নিয়মে, ব্যবস্থাপনায় থাকে জবাবদিহি। আপনি যত বড় পদেই থাকুন, ভুল করলে জবাবদিহি করতে হবে। এখানেই মানুষ সোজা হয়ে যায়। আর বাংলাদেশে? সেখানে দায়িত্ব জবাবদিহি ছাড়া, ক্ষমতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, বিচার শুধু গরিবের জন্য।

বিদেশে যে বাঙালি উচ্চশিক্ষিত নয়, সেও কয়েক বছরের পর বাড়ি কেনে, গাড়ি কেনে, সন্তানকে ভালো স্কুলে পাঠায়। অথচ ঐ দেশেরই বহু নাগরিক একটা ঘরের জন্য আজীবন লড়াই করে যায়। কারণ বাঙালি জানে—সঞ্চয় কাকে বলে, কীভাবে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়, কীভাবে পরিবার গড়ে তুলতে হয়। এটা শুধু টাকার হিসেব নয়—এ এক গভীর জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি।

আপনি যদি প্রবাসী বাঙালির উঠানে যান, দেখবেন—পুঁইশাক, লাউ, কুমড়ো, ঢেঁড়সে ছাওয়া এক টুকরো বাংলাদেশ। এমনকি যে ছেলেটি দেশে একটি গাছও লাগায়নি, তাকেও দেখবেন বিদেশে এসে সবজির বাগান করছে। এটা শুধু খাওয়ার জন্য নয়—এটা তার শিকড় ছড়িয়ে নিজের একটি জগৎ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।

এই প্রবণতা কেবল ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—ইউরোপের বহু দেশে প্রবাসী বাঙালিরাই বহুজাতিক সবজির বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কৃষিকে প্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশিরা। দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে নতুন নতুন সবজির আবাদ শুরু হয়েছে তাদের হাত ধরে। আমি নিজেই এক জ্বলন্ত প্রমাণ—শীতপ্রধান সুইডেনে ছোট্ট একটি সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি, সুইডিশদের নিয়েই।

তারপর যারা দেশে ‘ব্যর্থ’ ট্যাগ নিয়ে ঘুরেছে—তাদেরই আপনি আজ দেখবেন ইউরোপ, আমেরিকার বড় বড় গবেষণাগারে পিএইচডি করছে, পোস্টডকে যুক্ত। কেউ বৈশ্বিক সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধি, কেউ আন্তর্জাতিক সংস্থায় শীর্ষ পদে। কেন? কারণ বিদেশে তার শ্রম, মেধা, মনন—সবকিছুরই মূল্য রয়েছে। বিচার হয় কাজ দিয়ে, পরিচয় দিয়ে নয়।

আজ আমেরিকার এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে বাংলাদেশি নেই। অথচ সেই জাতিকেই আমরা দেশে অবহেলা করি, অবজ্ঞা করি, সুযোগ না দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিই। সেখানে তারা নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে শুধু নিজেরাই দাঁড়ায় না—বাংলাদেশের নামও তুলে ধরে।

বিদেশে যাদের ফুল ফোটে, দেশে তাদের পা ছুঁড়েই মারা হয়। তাহলে প্রশ্ন—এই উদ্ভাসন আমাদের দেশে হয় না কেন? উত্তর একটাই: সিস্টেম। আমাদের দেশে আজও বিচার হয় কে করল সেটা দেখে, কী করল সেটা নয়। দুর্নীতি হয় প্রকাশ্যে—তারপর বিচার হয় না। ক্ষমতা চলে কিছু গোষ্ঠীর হাতে, আর বাকি মানুষজন শুধু ভোট দিয়ে দায় সারে।

দেশে সংস্কারের নামে এক বছর পার হয়েছে—কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশ আগের চেয়ে আরও দশগুণ খারাপ হয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক, বিচারব্যবস্থা মেরুদণ্ডহীন, মিডিয়া নিস্তব্ধ, জনগণ হতাশ। এখানে আপনি যতই মেধাবী হন—আপনি যদি দলীয় ছাতার নিচে না থাকেন, আপনি কোথাও যাবেন না। এখন দরকার মৌলিক পরিবর্তন—শুধু মুখে নয়, বাস্তবে

   •    ব্যবস্থাপনার রূপান্তর—সিস্টেমটাই বদলাতে হবে।

   •    যে কেউ হোক, যে দলেরই হোক, দুর্নীতিতে যুক্ত হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

   •    ক্যাশ-নির্ভরতা পুরোপুরি তুলে ডিজিটাল পেমেন্ট শতভাগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

   •    প্রশাসনে কঠিন মনিটরিং চালু করতে হবে—স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং প্রযুক্তিনির্ভর।

   •    বিচারব্যবস্থায় ১০০% জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে—কে করল সেটা নয়, কী করল সেটা বিচার্য হতে হবে।

   •    নীতিনির্ধারণে দল নয়, জাতীয় স্বার্থই হবে প্রধান বিবেচ্য।

এই বোধ যতদিন আমাদের মাঝে না আসবে, ততদিন প্রবাসেই গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ, আর দেশীয় বাংলাদেশ শুধু প্রতিভার রক্ত দিয়ে বন্যা বইয়ে দেবে। এটাই বাস্তবতা। এটাই আজকের সবচেয়ে অপ্রিয়, কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সত্য। জাগো বাংলাদেশ জাগো। 

রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

‘কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যেন ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ না পায়’

‘কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যেন ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ না পায়’

জামায়াত আমিরকে দেখতে হাসপাতালে মির্জা ফখরুল

জামায়াত আমিরকে দেখতে হাসপাতালে মির্জা ফখরুল

কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষার আহ্বান

কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষার আহ্বান

নাসীরুদ্দীনের ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য: বিএনপির বিক্ষোভের মুখে এনসিপির সভা পণ্ড

নাসীরুদ্দীনের ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য: বিএনপির বিক্ষোভের মুখে এনসিপির সভা পণ্ড

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App