সিনথেটিক মাদকের ভয়াল থাবায় যুব সমাজ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সিনথেটিক মাদক জব্দের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও সেখানে মাদকের ব্যাপক উৎপাদনের খবর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের মাদক চক্রগুলো মেটাঅ্যামফিটামিন, এক্সট্যাসি, কেটামিন এবং ইয়াবার মতো মাদক কম দামে উৎপাদন করে এই অঞ্চলে সরবরাহ করছে।
মিয়ানমার: মাদক উৎপাদনের কেন্দ্র
মিয়ানমারের শান রাজ্য সিনথেটিক মাদকের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (থাইল্যান্ড, লাওস এবং মিয়ানমারের একটি অংশ) অঞ্চলটি মাদক পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের (ইউএনওডিসি) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, থাইল্যান্ডে ২০২৩ সালে ৬৪৮.৯ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ২৬.৪ টন ক্রিস্টাল আইস জব্দ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে জব্দ হয়েছিল ৩৯৫ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ১৭.৬ টন আইস।
থাইল্যান্ডে পরিস্থিতি অবনতি
থাইল্যান্ডের নারকোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড (ওএনসিবি) জানিয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় পরিস্থিতি আরও খারাপ। সে সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম ও দ্রুত বর্ধনশীল ক্রিস্টাল মেথের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন মাদক জব্দের পরিমাণ ৮ গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে থাই কর্তৃপক্ষ ৪৮৮ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং প্রায় ১০ টন আইস জব্দ করেছে। ওএনসিবি বলেছে, আইস জব্দের পরিমাণ গত তিন বছরে ওঠানামা করছে... প্রথমে এগুলো দক্ষিণ থাইল্যান্ডে পাচার করা হয়, পরে সেখান থেকে তৃতীয় দেশে পাঠানো হয়।
মাদক উৎপাদন ও পাচারের কৌশল
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ফলে সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। ইউএনওডিসি জানিয়েছে, এই চক্রগুলো রাসায়নিকের খরচ কমিয়ে উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে, এক টনের বেশি মাদক পরিবহনকারী চালান এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
২০১৯ সালে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ১৪০ টন মেটাঅ্যামফিটামিন জব্দ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০ টনে। চক্রগুলো উচ্চ বিশুদ্ধতার সিনথেটিক মাদক তৈরি করছে, যা আগে থেকে অনেক সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ক্রিস্টাল মেথের পাইকারি মূল্য প্রতি কেজি ছিল ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালে কমে ৪ থেকে ৭ হাজার মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে।
মাদক পরিবহনে সমুদ্রপথের ব্যবহার বৃদ্ধি
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে নিরাপত্তা অভিযান বাড়ার কারণে মাদক চক্রগুলো স্থলপথ থেকে সমুদ্রপথের দিকে ঝুঁকছে। ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চক্রগুলো সমুদ্রপথের সঙ্গে স্থলভিত্তিক পাচার করিডরের সংযোগ স্থাপন করছে।
সিঙ্গাপুরে মাদকের ক্রমবর্ধমান প্রভাব
সিঙ্গাপুরের সেন্ট্রাল নারকোটিকস ব্যুরোর (সিএনবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়া মাদকসেবীদের মধ্যে ১,৬২১ জন মেথ ব্যবহারকারী, যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন মাদকসেবীদের মধ্যে ৫৯৯ জন মেটাঅ্যামফিটামিন ব্যবহার করেছেন। ২০২৩ সালে ২০ বছরের কম বয়সী মেথ ব্যবহারকারীদের সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মনোবিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু দা রোজা সতর্ক করেছেন, মাদকের সহজলভ্যতা গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করতে পারে। তিনি বলেছেন, “সরবরাহ বাড়লে নতুন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে এবং পুরোনো ব্যবহারকারীরা আরও বেশি ডোজ কিনবে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।”
মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মাদকের বিস্তার
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়। এর পর থেকে দেশটি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেথ উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শান রাজ্যে সংঘাত চলমান থাকায় মাদক উৎপাদন ও পাচার বাড়ছে। মিয়ানমারের সেন্ট্রাল কমিটি ফর ড্রাগ অ্যাবিউজ কন্ট্রোলের প্রধান সো হুত ২০২৩ সালের জুনে বলেন, “অসংখ্য গ্রেপ্তার ও বিচার কার্যক্রম সত্ত্বেও মাদক উৎপাদন বা পাচার কমছে না।”
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রকাশ করেন যে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো মাদক-বাণিজ্য থেকে লাভবান হচ্ছে।
সিনথেটিক মাদকের উৎপাদন ও পাচারের বিস্তার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং কার্যকর নীতিমালা ছাড়া এই সংকটের মোকাবিলা করা কঠিন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।