রাজধানীতে বৈধ ছাড়পত্র নেয়া রেস্তোরাঁর সংখ্যা কত?

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৯:১৯ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
লাইসেন্স ছাড়া রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর। ৮ তলা ঐ ভবনে আগুনে নিহত হন ৪৬ জন। ভবনে ৮টি রেস্তোরাঁ ছিলো। যদিও ভবনটিতে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদনই ছিলো না। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে সরকার।
সরকারের সব সংস্থার প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিয়ে রাজধানীতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছে মাত্র ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ১২৮টি রেস্তোরাঁ। এছাড়া ঢাকা জেলার মধ্যে শুধু সাভারের ৬টি রেস্তোরাঁর লাইসেন্স রয়েছে।
বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার জন্য নিবন্ধন (অনুমতি) নিতে হয়। এই নিবন্ধন পাওয়ার পর ডিসি কার্যালয় থেকেই রেস্তোরাঁ ব্যবসার লাইসেন্স (সনদ) নিতে হয়। আইন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর এক বছরের মধ্যে ডিসি কার্যালয় লাইসেন্স দেবে নিবন্ধন পাওয়া রেস্তোরাঁকে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন ও সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয় একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীকে। এর বাইরে দই ও বোরহানির মতো বোতল বা প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য কোনো রেস্তোরাঁ বিক্রি করলে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিতে হয়।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম হচ্ছে নিবন্ধন পাওয়ার পর রেস্তোরাঁ নির্মাণের কাজ শুরু করবেন একজন বিনিয়োগকারী। একই সঙ্গে তিনি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সরকারি অন্যান্য সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও ছাড়পত্র নেবেন। লাইসেন্স পাওয়ার আগে কোনো রেস্তোরাঁ খাবার বিক্রি করতে পারবে না। যেসব রেস্তোরাঁর লাইসেন্স আছে, শুধু তারাই বৈধ। আবার নিবন্ধন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ আবেদন না করলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কারওয়ান বাজারের ‘রেস্টুরেন্ট লা ভিঞ্চি’ ২০০১ সালে প্রথম লাইসেন্স নিয়ে রাজধানীতে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালে কারওয়ান বাজার ও ঠাঁটারীবাজার শাখার জন্য লাইসেন্স নেয় হোটেল সুপার স্টার লিমিটেড। একই বছর আরো তিনটি প্রতিষ্ঠান রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেয়। কেএফসি এবং পিৎজা হাটের শাখাগুলোও লাইসেন্স এবং নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা করছে।
২০২২ সাল থেকে লাইসেন্স নিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার প্রবণতা কিছুটা বাড়তে দেখা যায়। ২০২২ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েছে। এরপর ২০২৩ সালে ৩০টি এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠান রেস্তোরাঁ ব্যবসার লাইসেন্স নিয়েছে।
লাইসেন্স পেতে এখন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন আছে ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের; যারা এরই মধ্যে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিবন্ধন পেয়েছে।
এদিকে বেইলি রোডের ঘটনায় রাজধানীজুড়ে অভিযান শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। সংস্থাগুলোর অভিযানে রেস্তোরাঁর কর্মীদের গ্রেফতার ও জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপি ১ হাজার ১৩২টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করে। রাজউক ৩৩টি ভবনে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন দুটি ভবন ও দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করার পাশাপাশি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। এর বাইরে সারা বছরই রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থা।
রেস্তোরাঁ কাকে বলে
বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, ৩০ জন বা এর চেয়ে বেশি মানুষ যেখানে বসে মানসম্মত খাবার টাকার বিনিময়ে খেতে পারবেন, সেটিই রেস্তোরাঁ।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে, ঢাকায় রেস্তোরাঁর সংখ্যা এখন ২৭ হাজারের মতো। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজধানীতে রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হবে।
রেস্তোরাঁর মালিকদের দাবি, নিবন্ধন ও লাইসেন্সপ্রক্রিয়া অনেক জটিল। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দফতরে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা হয়রান।
নিবন্ধন ও লাইসেন্সপ্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, সব বিষয় ছাড় দিলে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় না। অনেকেই নিয়ম না মেনে ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের দেওয়া আইন ও বিধি মানতে রেস্তোরাঁর মালিকদের অনেকেই আগ্রহী নন। যেন-তেনভাবে ব্যবসা করে বেশি মুনাফা করার প্রবণতা অনেক বেশি।
রেস্তোরাঁর নিবন্ধন নিতে জমা দিতে হয় যেসব নথি
রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে চাইলে প্রথমে নিবন্ধন করতে হয়। এজন্য বেশ কিছু নথি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। নিজের জমিতে রেস্তোরাঁ করলে একরকম নথি এবং ভাড়া করা ভবনে করলে আরেক রকম নথি দিতে হয়।
নিজ জমিতে রেস্তোরাঁ করার ক্ষেত্রে জমা দিতে হয়: ১. জমির মালিকানার মূল দলিল, নামজারি, বাড়িভাড়া বা ইজারা চুক্তির সত্যায়িত কপি। ২. ভবন নির্মাণের অনুমোদন ও শর্ত পূরণসংক্রান্ত দলিলাদির সত্যায়িত কপি। ৩. ডিটেইল স্ট্রাকচারাল প্ল্যান, নকশা ও সুবিধাদির বিবরণসংক্রান্ত দলিলাদির সত্যায়িত কপি। ৪. ব্যবসা পরিচালনা-সংশ্লিষ্ট অনুমতিপত্র, ট্রেড লাইসেন্স বা সনদের সত্যায়িত কপি। ৫. ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে আবেদন ফি জমা দেওয়ার কপি। ৬. বিগত অর্থবছরে পরিশোধিত আয়কর প্রদানের প্রমাণকের সত্যায়িত ফটোকপি। ৭. ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিসহ স্বত্বাধিকারী/অংশীদার/পরিচালকবৃন্দের নাম ও ঠিকানা। ৮. মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস (সংঘস্মারক) এবং মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনের (সংঘবিধি) সত্যায়িত ফটোকপি।
এসব নথি দেওয়ার পর রেস্তোরাঁর নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। ইস্যুর তারিখের পরের এক বছরের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা দিতে হয়।
এর মধ্যে রয়েছে নিবন্ধন সনদের সত্যায়িত কপি। ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে লাইসেন্স ফি প্রদানের মূল কপি এবং আবেদনকারীর অঙ্গীকারনামা। সিভিল সার্জন বা সরকার অনুমোদিত কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের দেওয়া হোটেল কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বাস্থ্যগত সনদ। হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি। বিগত অর্থবছরে পরিশোধিত আয়কর প্রত্যয়নপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নিবন্ধন নম্বর ও প্রত্যয়নপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি। পরিবেশগত ছাড়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি। অগ্নি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দুর্ঘটনার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সনদপত্রের সত্যায়িত কপি। রাজউক/পৌরসভা/উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্ল্যান (পরিকল্পনা) ও ডিজাইনের (নকশা) সত্যায়িত ফটোকপি। স্বত্বাধিকারী পরিচালকদের ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সনদপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি এবং কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সনদপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি।
নিবন্ধন ও লাইসেন্স ফি
রেস্তোরাঁর আসনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নিবন্ধন ও লাইসেন্স ফি নির্ধারণ করা হয়। আবার আসনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে রেস্তোরাঁর ধরনও ঠিক করা হয়। যেমন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে রেস্তোরাঁয় যদি ৩০ থেকে ১০০ আসন থাকে, তাহলে এর ধরন হবে ‘ডি’। সেক্ষেত্রে রেস্তোরাঁয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা (এসি) থাকলে নিবন্ধন ফি ৩০০০ টাকা আর নন-এসি হলে ২০০০ টাকা দিতে হয়। রেস্তোরাঁয় ১০১ থেকে ২০০ আসন থাকলে এর ধরন হবে ‘সি’। সেক্ষেত্রে এসি হলে ৩৫০০ টাকা আর এসি না থাকলে ২৫০০ টাকা ফি হিসেবে সরকারি কোষাগারে দিতে হয়। একইভাবে ২০১ থেকে ৩০০ আসন পর্যন্ত হলে তার ধরন হবে ‘বি’। আর ৩০০ আসনের বেশি থাকলে তার ধরন হবে ‘এ’। সেক্ষেত্রে ‘বি’ ধরনের ফি (এসি) ৪০০০ আর নন-এসি হলে ৩০০০ টাকা। আর রেস্তোরাঁর ধরন ‘এ’ (এসি) হলে ৪৫০০ টাকা, নন-এসি হলে ৩৫০০ টাকা।
আবার লাইসেন্স করার সময়ও সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত পরিমাণ ফি জমা দিতে হয়। যেমন রেস্তোরাঁর ধরন ‘এ’ হলে এবং এসি থাকলে ১৫ হাজার টাকা আর এসি না থাকলে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। ‘সি’ হলে (এসি) ১৮ হাজার টাকা আর এসি না থাকলে সাড়ে ১২ হাজার টাকা, ‘বি’-এর জন্য (এসি) ২০ হাজার টাকা আর এসি না থাকলে ১৫ হাজার টাকা। রেস্তোরাঁর ধরন ‘এ’ হলে এবং এসি থাকলে ২৫ হাজার এবং নন-এসি হলে ২০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
রেস্তোরাঁর লাইসেন্স নেয়ার তিন বছর পর পর তা নবায়ন করতে হয়। নবায়ন করতেও আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেন, লাইসেন্স নিতে গেলে ভবনের মূল দলিলের ফটোকপি, ভবনের নকশার অনুমোদন জমা দিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবন মালিকেরা এসব নথি রেস্তোরাঁর মালিকদের দিতে চান না। আবার সরকারের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে রেস্তোরাঁর মালিকদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এত ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স করেননি। তবে লাইসেন্স না করলেও বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ মালিক অগ্নি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দুর্ঘটনার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের সনদপত্র নিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি। এখন সংখ্যাটি ৫ লাখের বেশি হবে বলে ধারণা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির। ঐ জরিপ অনুযায়ী, রেস্তোরাঁ খাতে যুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ ৭২ হাজার। শুধু পুরুষ নন, রেস্তোরাঁগুলোতে ১ লাখের বেশি নারীও কাজ করেন।