নোয়াখালীতে কোথাও উন্নতি, কোথাও অবনতি, ত্রাণের জন্য হাহাকার

নোয়াখালী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪০ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
ভারি বৃষ্টিপাত ও ফেনী থেকে আসা উজানের পানির চাপ অব্যাহত থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কোথাও উন্নতি এবং কোথাও অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে জেলা শহর মাইজদীসহ সদর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার দুর্গম অনেক এলাকায় ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে জানান বাসিন্দারা। ফলে পর্যাপ্ত ত্রাণ পেতে হাহাকার করছে বন্যার্তরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সেনবাগ, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যা কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। আর জেলা শহর মাইজদীসহ সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
গতকাল (সোমবার ২৬ আগস্ট) রাতে এবং আজ (মঙ্গলবার ২৭ আগস্ট) সকালে বৃষ্টিপাতের ফলে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সোমবার সকাল নয়টা থেকে আজ (মঙ্গলবার) সকাল নয়টা পর্যন্ত জেলা শহর মাইজদীতে ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় ৩৮ মিলিমিটার কম। আগের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১০২ মিলিমিটার। আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও জেলায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকলেও জেলার বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। অথচ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রাণবাহী অনেক গাড়ি প্রতিদিনই নোয়াখালী ঢুকছে। মূলত প্রশাসনের সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আরো পড়ুন: বিদ্যুৎ সংযোগ সচল করতে গিয়ে ৩ জনের মৃত্যু
সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের লুদুয়া গ্রামের বাসিন্দা সেনাসদস্য মো. মামুন বলেন, তিনি দুই দিন ধরে উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছেন ত্রাণের জন্য। কিন্তু এখনো ত্রাণ পাননি। ব্যক্তিগতভাবে কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন। তার এলাকার বেশির ভাগ মানুষ এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পায়নি। এ অবস্থায় ত্রাণের জন্য বন্যায় পানিবন্দী মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আখিনূর জাহান নীলা বলেন, নোয়াখালী শহর ও সদরের বেশির ভাগ ইউনিয়নে বন্যার পানি এখনো কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখানে বন্যাকবলিত অনেক মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত চাল, নগদ টাকা ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। অসুস্থদের দেয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।
তবে আশ্রয়ন কেন্দ্রে আশ্রিতরা সরকারি, ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে খাবার ও চিকিৎসা সুবিধা পেলেও গ্রামের দুর্গম এলাকার পানিবন্দি মানুষ ত্রাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন বলে অভিযোগ অনেকেরই।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে সদর উপজেলার নোয়াখালী ইউনিয়নের মান্নান নগর এলাকার বন্যায় পানিবন্দি সরকারি ত্রাণ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মধ্যে স্থানীয় সেনাসদস্য জহিরুল ইসলাম ও নোবিপ্রবি প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এসময় ভোরের কাগজ ও নাগরিক টেলিভিশনের সাংবাদিক মোহাম্মদ সোহেল, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন মঞ্জু'সহ স্থানীয় যুব সমাজের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার বিকেলে জেলা শহরের হাউজিং, মেথরপট্টি, নোয়াখালী কলেজ এলাকা, কোম্পানিগঞ্জ, সেনবাবাগ, সোনাইমুড়ী উপজেলাসহ বন্যাকবলিত এলাকায় বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এন-রাশ। এ সময় সংস্থার প্রধান নির্বাহী আবুল হাশেম, পরিচালক মো. আকরাম হোসেন হৃদয়সহ সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরো পড়ুন: বন্যা পরিস্থিতি: পানি কমলেও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ যাবে কোথায়?
মঙ্গলবার সকালে জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হাকিম কোয়ার্টার, কাজী কলোনি, হরিনারায়ণপুর ও রশিদ কলোনি, গোপাই রামশংকর, নোয়াখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এলাকাতেই আগের দিনের তুলনায় বন্যার পানি কিছুটা বেড়েছে। বাসাবাড়িগুলো হাঁটুসমান বন্যার পানিতে ডুবে আছে। মূল শহর থেকে দূরের এলাকাগুলোতে প্রায় কোমর সমান পানি। শহরের গণপূর্ত ভবনের সামনে, টাউন হল মোড়, জামে মসজিদ মোড়, পৌর বাজার ও গ্যারেজ এলাকা প্লাবিত হয়ে আছে।
অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটছে জানিয়ে হরিনারায়ণপুর এলাকার বাসিন্দা ঝরনা বেগম বলেন, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না তারা। ডাল-আলু রান্না করে কোনোমতে দিন পার করছেন। একই কষ্টের কথা জানান, সদর উপজেলার পশ্চিম চরউরিয়া এলাকার গৃহবধূ মাহমুদা আক্তার রুপালি। তিনি বলেন, ঘরে-বাইরে সবখানে পানি। মাচার ওপর বিকল্প চুলা তৈরি করে রান্না করেন। পানির কারণে বাজারেও যেতে পারছেন না পরিবারের লোকজন।
এদিকে, সোমবার জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় বন্যায় বিচ্ছিন্ন হওয়া বিদ্যুৎ লাইন সচল করতে গিয়ে দুই লাইনম্যানসহ পৃথক স্থানে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই পর্যন্ত জেলায় বন্যায় ৬ জনের প্রাণহানী ঘটেছে।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলা শহর মাইজদী ও আশপাশের এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হলেও জেলার কয়েকটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জেলার দুর্গম কয়েকটা এলাকায় রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম এবং ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে।