বন্যা পরিস্থিতি
ফেনীর জলে ডুবল নোয়াখালী
পানিবন্দি রয়েছে ১২ লাখ পরিবার > প্রাণহানি বেড়ে ২৭ জনে উন্নীত > গোমতী ও কাপ্তাই হ্রদে পানি বাড়ছে

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ।
দেশে সপ্তাহ খানেক ধরে চলা বন্যার পরিস্থিতির বেশির ভাগ এলাকায় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ফেনী থেকে নামা বানের পানিতে এখন ডুবছে নোয়াখালী এবং কুমিল্লা জেলার কিছু অংশ। নোয়াখালীর সব নদীর পানি বাড়ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গোমতী নদীর পানি বইছে বিপৎসীমার উপর দিয়ে। এতে নতুন নতুন এলাকা ডুবছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকাও। দুর্ভাগে পড়ছেন বন্যাকবলিত মানুষ। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষুধার্ত অধিকাংশ শিশু। দেখা দিয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। বন্যাকবলিত ১০ জেলার পানি নামতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি। খাবারের জন্য এখনো হাহাকার চলছে বন্যাদুর্গত সব জেলায়। বানের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার পর দুর্গতদের বেশিরভাগই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যাকবলিত ১১ জেলায় এখনো পানিবন্দি আছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে।
উজান থেকে প্রবল বেগে নেমে আসা ঢল এবং অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত ২০ আগস্ট থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিকভাবে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা বিস্তৃত হয় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
বিপৎসীমার উপর পানি : দেশের বেশির ভাগ নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। কেবল কুমিল্লায় গোমতী এবং খাগড়াছড়িতে কাপ্তাই নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে বইছে। গতকাল সকাল ৯টায় কুমিল্লা স্টেশনে গোমতীর পানি ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানি কমেছে ৩২ সেন্টিমিটার।
উজানের তথ্যের ভিত্তিতে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ফেনীর পরশুরাম পয়েন্টে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করছে। সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা ও ফেনীর বিভিন্ন নদীর পানি অন্তত আগামী ২৪ ঘণ্টা কমে যাবে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সাঙ্গু, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, হালদাসহ অন্যান্য নদীর পানিও কমতে পারে বলে বুলেটিনে জানানো হয়েছে।
বন্যার অবনতি : নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৮টিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যার পানি। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে বন্যার্ত মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জয় কৃষ্ণরামপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় নিয়েছেন বিধবা হোসনে আরা। তিনি বলেন, এখানে থাকার ও শুমানোর মতো অবস্থা নেই। আল্লাহ আমাদের এভাবে রাখছে। একটা জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। আমার সামর্থ্য নেই ঘরবাড়ি করার। ছেলেরাও গরিব। কিচ্ছু করতে পারবে না তারা।
সাহেরা খাতুন নামে আরেকজন বলেন, রাস্তায় পানি। পরিবারের পুরুষরা কাজকর্ম করতে পারে না। আমরা এখন আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। অনেক কষ্ট করে আছি। কেউ খোঁজ খবর নেয় না। আমরা এখন কীভাবে বাঁচব, জানি না। আমরা সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা চাই। অনেকে সহায়তা পায় শুনি, কিন্তু আমরা চোখে দেখি না। আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে উপোস থাকি। কোনো উপায়ে আমরা সাহায্য পাই না।
বন্যা না কমলে সব শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে বৃদ্ধা শাহ আলম বলেন, এত পানি আমি ৭০ সালেও দেখিনি। ২০২৪ সালে পানি আর পানি। আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। যদি বন্যা না কমে, আমাদের ঘর বাড়ি সব উল্টে যাবে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের খাবারের একটু সমস্যা ছিল। এখন আমরা পর্যাপ্ত শুকনো খাবার পাচ্ছি। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা আসছে, ব্যক্তিগতভাবে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসছে। তাছাড়া সরকারিভাবে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানি বেড়েই চলেছে। এতে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে উপজেলার অন্তত ৮টি ইউনিয়নের বন্যা। পানিবন্দিদের উদ্ধারে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন সমাজিক সংগঠন কাজ করছে। দুর্গতদের উদ্ধারে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাক। উদ্ধারের পর ট্রাকযোগে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে।
স্থানীয়রা জানায়, গত ১ সপ্তহ ধরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এখনো পনিবন্দি হয়ে আটকা রয়েছে।
কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা, পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী এবং ডাকাতিয়া নদীর পানি বেড়ে বেশ কয়েকটি এলাকার বাঁধ ভেঙে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা বলেন, উপজেলায় ১০৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ওইসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১২ হাজারের অধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। পানিবন্দি পরিবারগুলোকে উদ্ধারে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন সমাজিক সংগঠন কাজ করছে। দুর্গতদের উদ্ধারে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাক।
কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য মতে, কাপ্তাই হ্রদের পানির ধারণক্ষমতা ১০৯ মিন সি লেভেল (এমএসএল)। হ্রদে পানি রয়েছে ১০৮ দশমিক ৯২ এমএসএল। পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় বাঁধের ১৬টি জলকপাট দিয়ে ছয় ইঞ্চির পরিবর্তে গতকাল সকাল থেকে এক ফুট করে ১৮ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে।
জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আব্দুজ্জাহের জানান, উজানে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় হ্রদের পানি ছাড়ার পরও পানি বাড়ছে। তাই সকাল থেকে স্পিলওয়ের গেট ছয় ইঞ্চির পরিবর্তে এক ফুট করে ১৮ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে। যদি পানি এভাবে বাড়ে তাহলে পানি ছাড়ার পরিমাণ বাড়ানো হবে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য, জেলার রাঙ্গামাটি সদর, লংগদু, বরকল, নানিয়াচর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন তাদের রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, পানিবন্দি মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বাঁধের পানি ছাড়া অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, অল্প কিছুদিনের মধ্যে পানি কমে আসবে।
ল²ীপুরে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বজনদের বাড়িতে উঠেছেন। অনেকে আবার কষ্ট করে হলেও অবস্থান করছেন বাড়িতে। চারদিকে পানি থাকায় খাটের ওপর থাকছেন, আর সেখানেই চলছে রান্নাবান্না। কোমর পানিতে যাতায়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে এসব মানুষকে। এছাড়া সুপেয় পানিরও অভাব দেখা দিয়েছে। গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে রয়েছেন গৃহস্থরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ল²ীপুর পৌরসভার লামচরী, মধ্য বাঞ্চানগর, শিশু পার্ক এলাকা ও লাহারকান্দি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি। এসব এলাকার ১২ হাজার ৭৫০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে স্বজনদের বাড়ি গিয়ে উঠেছেন।
ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া বাড়ি-ঘর ও এলাকাগুলোতে পানি কিছুটা কমেছে। তবে যে ক্ষত তা থেকে উঠা এখনো সম্ভব হয়নি। এলাকাগুলোতে এখনো ঘরে ফেরার উপক্রম হয়নি। নতুন করে মুছাপুরে ক্লোজার ভেঙে যাওয়ায় চর এলাকার বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে বেড়েছে ভিড়।
দাগনভূঞা উপজেলার দাগনভূঞা বাজার, বেকের বাজার, সিলোনিয়া বাজার, ফাজিলের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় বড় মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, কলেজ ও বহুতল ভবনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া প্লাবিত এলাকার বহুতল ভবনেও আশ্রয় নিয়েছে এলাকার বাসিন্দারা। ব্যবস্থা হয়েছে হেলথ ক্যাম্পেরও।
মৃত্যু বেড়ে ২৭ : গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম জানান, বন্যায় নতুন করে ৪ জন মারা যাওয়ায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭। এর মধ্যে কুমিল্লায় মারা গেছে ১০ জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে ৫ জন করে এবং কক্সবাজারে ৩ জন মারা গেছে। এছাড়া ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ল²ীপুরে মারা গেছে ১ জন করে। তিনি বলেন, বন্যায় বর্তমানে ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন।
দুর্গতদের জন্য ৩ হাজার ৮৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা আছে জানিয়ে কে এম আলী রেজা বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদি পশুও সেখানে আশ্রয় পেয়েছে। দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।