লালমনিরহাটে কৃত্রিম সংকটে সারের দাম বৃদ্ধি, দিশেহারা কৃষক

রবিউল ইসলাম বাবুল, লালমনিরহাট
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
লালমনিরহাট জেলায় রবি মৌসুমের শুরুতেই ব্যাপক সার সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে জেলার পাঁচ উপজেলার কৃষক দিশেহারা হয়ে পরেছে। এছাড়া সার সংকট থাকায় রবি মৌসুমী ফলন বিপর্যের আশঙ্কা করছেন কৃষক। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) লালমনিরহাট জেলার হাট বাজারের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেলো এমন চিত্র।
নাম প্রকাশ্যে একজন সার ব্যবসায়ী বলেন, বিসিআইসি ডিলারের কাছে সার নিতে গেলে বলে সার শেষ। বরাদ্দ আসলে পাবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন, বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই রাতের আধাঁরে অটোরিকশা-ভ্যানগাড়ি, ট্রাক বোঝাই করে বেশি দামে অন্যত্র সার বিক্রয় করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এর ফলে কৃষক সঠিক সময়ে সার পাচ্ছেন না। এভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক সার ডিলার আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন রাতারাতি। এই যেন দেখার কেউ নেই। প্রশাসন রয়েছে নীরব ভূমিকায়।
জেলার হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার ভুট্টা চাষি রইচ উদ্দিন ও আবজাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ভুট্টা চাষাবাদ শুরু হতেই বাজার থেকে সার উধাও হয়ে গেছে। সার কিনতে গেলে ডিলাররা সাফ জানিয়ে দেন বরাদ্দ না থাকার কারণে সার নেই। না অজুহাতে ফিরিয়ে দেন কৃষকদের। আবার বেশি টাকা দিলে সার মিলে। ডিলারদের কাছে গেলে সরবরাহ নেই অজুহাতে সার নেই বলে ফিরে দিচ্ছেন কৃষকদের। তাই চাষাবাদ করতে অধিকমূল্যে বাজারের দোকানগুলো থেকে সার কিনতে হচ্ছে দরিদ্র কৃষকদের।
জেলা উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিভাগের সঠিক তদারকি না থাকায় ডিলাররা সহজেই এ কাজগুলো করছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। এছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে নাম করা হাতে গোনা হেবীওয়েট ব্যবসায়ীরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মতো করছে এমন কাজ। শুধু কৃষি দপ্তর নয়, জেলার কেউ মুখ খুলে কিছু বলার সাহস পায় না তাদের বিরুদ্ধে । জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সুশীল সমাজের লোকদের দাবি ঐ সকল রাঘোব বোয়ালদের লাইসেন্স বাতিল করলে বাজারে সারের সংকট দূর হবে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েক জন কৃষক জানান, নভেম্বর মাসে রবি মৌসুমে চাষাবাদ শুরু হয়। ডিসেম্বরে আলু, ভুট্টা, সরিষা, গমসহ নানা সবজি চাষ করেন কৃষক। এসময় জমিতে পর্যাপ্ত সার প্রয়োগ প্রয়োজন হয়। ফলে রবি মৌসুমে সারের চাহিদা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি থাকে। বর্তমানে কৃষকরা রবি ফসল চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মৌসুমের শুরুতে চাহিদা মতো সার না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষক।
উত্তরের জেলা লালমনিরহাট উপজেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলায় চলছে রবি বীজ বুনন কার্যক্রম। বীজ বুননের আগে জমি তৈরি করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হচ্ছে চাষিদের। এ মৌসুমে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় বিপাকে পরেছে জেলার কৃষকরা। ফলে বাজারে সার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের কতিপয় অসাধু বিক্রেতা অধিকমূল্যে সার বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ কৃষকদের। তারা বলেন, সার যদিও পাওয়া যায় তা বেশি দামে কিনতে হয়। জেলার খুচরা বাজারগুলোতে টিএসপি ১৮ শত টাকা পটাশ, ১৫ শত টাকা ইউরিয়া, ১৫ শত টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের যথা সময়ে তদারকি না থাকায় ঐ সব অসাধু সার ব্যবসায়ী ইচ্ছে মতো কৃষকদের নিকট সারের দাম নিচ্ছেন বলে জানান তারা।
বাজারে সার দোকান ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই অনিবন্ধিত ব্যবসায়ী। এসব বিক্রেতা মৌসুম শুরুর আগে ডিলারদের কাছ থেকে সার ক্রয় করে গুদাম জাত করার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। আবার সুযোগ বুঝে বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে অধিক দামে সার কিনে চাষাবাদ করছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন চাষিরা।
সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে বর্তমান বাংলা টিএসপি প্রতিবস্তা ১৩৫০ টাকার স্থলে, বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ টাকা এবং বাংলা পতেঙ্গা ১২৫০ টাকার স্থলে ২"হাজার টাকা দামে কিনতে হচ্ছে অনিবন্ধিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। আবাদ শুরুতে এমন ধাক্কা খেয়ে উৎপাদন খরচে যেমন দিতে চড়া মূল্য তেমনি চাষাবাদ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকদের।
আদিতমারীর উপজেলার সৌনিক পাড়া কৃষক নুর-ইসলাম বলেন, বাজারে সার নেই। যদিও পাওয়া যায় বেমি দামে কিনতে হয়। তাছাড়া তামাক চাষ করতে প্রচুর পরিমাণ সার লাগে। চাষাবাদের শুরুতেই সারের সংকট দেখা দিয়েছে বাজারের দোকান গুলোতে। ডিলারদের কাছে গেলে তারা বলেন সার নেই। খুচরা বিক্রেতারা বাংলা টিএসপি ও ডিএপি সার বস্তা প্রতি ৪/শত থেকে ৫ শত টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে। অন্যদিকে নিবন্ধিত বেশ কিছু ডিলারের গুদামে যথেষ্ট সার থাকা সত্বেও তারা বলছেন সার নেই। বরাদ্দ যেটা পেয়েছি সব শেষ। এ জন্যই মূলত সারের সংকট তৈরি হয়েছে। সঠিক সময়ে সার না পেলে রবি মৌসুমে চাষাবাদে ফলন অনেক কম হওয়ারও আশংকা রয়েছে। তাই সার নিয়ে বড় চিন্তায় আছি ?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার বলেন, লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ৩ টিতে ব্যাপক হারে তামাক চাষ হয়। পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধায় ব্যাপক চাষ হয় ভুট্টা। তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে তামাকের জন্য কোন সার বরাদ্দ চায় না কৃষি বিভাগ। তামাক চাষেও প্রচুর পরিমাণ সার লাগে। যার বরাদ্দই দেয় না কৃষি বিভাগ। ফলে তামাকের জমির বিপুল পরিমাণ সার সরবরাহ করতে এ রবি মৌসুমে সারের এ ঘাটতি থেকে যায়। সংকট দূর করতে হলে তামাক চাষে কৃষদের নিরুৎসাহী করতে হবে। যেহেতু এ জেলায় তামাক চাষ বেশী হয় এবং চাষিরা এসব সার তামাক ক্ষেতে প্রয়োগ করেন। তাই তাদের চাহিদা বিবেচনা করে সারের বরাদ্দ দেয়া উচিৎ বলে তিনি জানান। তা না হলে সংকট থেকে যাবে।
এই বিষয়ে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড.সাইফুল আরেফিন ভোরের কাগজকে বলেন, নভেম্বর মাসে বরাদ্দের কিছু অংশ পর্যন্ত বাফার গুদামে মজুদ আছে। ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দ এসেছে। এখন বাজারে সারের কোন সংকট থাকবে না । কিছু অসাধু ব্যক্তি গুজব সৃষ্টি করে বাজারে সার নেই বলে সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যে সব সার ব্যবসায়ী ডিলার অধিক মূল্যে সার বিক্রি করবে, তার প্রমাণ পেলে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি, কৃষকদের ডিলারদের কাছে নির্ধারিত মূল্যে সার কেনার আহ্বান জানান। কেউ বেশি চাইলে কৃষি দপ্তরকে অবহিত করার পরামর্শ দেন।