ফিরে দেখা-২০২৪
বছরজুড়ে ছিল নৃশংস হত্যাকাণ্ড, চোরের উপদ্রব ও অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য

মাসুম বাদশাহ, সিংগাইর (মানিকগঞ্জ):
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
আলোচিত ২০২৪ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে বছরজুড়ে ছিল নৃশংস হত্যাকাণ্ড, চোরের উপদ্রব ও অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শুরুর দিকে এসব অপরাধ দমনে কঠোর হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বছরের শেষের দিকে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে। তবে তাদের দাবি- পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পরকীয়া প্রেম ও মাদক ব্যবসার জের ধরে অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটলেও রহস্য উন্মোচনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে সারা বছর উপজেলার পাড়া-মহল্লায় চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পেলেও কোনোভাবেই চুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও ছিল সক্রিয়। খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অনেক পরিবার থেকে লুট করা হয়েছে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারসহ মালামাল।
থানা পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ৬ ডিসেম্বর সকালে জয়মন্টপ ইউনিয়নের পূর্বভাকুম গ্রামের গলাকাটা ব্রীজের উত্তর পাশের চকের টমেটো ক্ষেত থেকে কামাল হোসেন (৪৮) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত কামাল হোসেন ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার কাছিনা ব্যাপারীপাড়া গ্রামের আলা উদ্দিনের ছেলে। ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
গত ২৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামে সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী তানিয়া আক্তার পরকীয়া প্রেমের জেরে খুন হন। খুনের সঙ্গে জড়িত মাদরাসা শিক্ষক প্রেমিক মাহাদী হাসান গ্রেপ্তার হয়েছে। গত ৮ নভেম্বর দুপুরে ফোর্ডনগর ধলেশ্বরী নদীর মিলনের ঘাট থেকে রুবেল নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুনের আগে রুবেল প্রতিবেশী ভাতিজা বিজয় ও তার প্রেমিকা শ্রাবনীর আপত্তিকর ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করার চেষ্টা করলে ৮ নভেম্বর রাতে বাড়ি থেকে ফোনে ডেকে নিয়ে হত্যা কারে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
তালেবপুর ইউনিয়নের উত্তর কাংশা গ্রামে ভাবী মনিরার সঙ্গে দেবর ঝন্টু পরকীয়া প্রেমের জের ধরে সিংগাপুর প্রবাসী বড় ভাই উজ্জল নামের এক ব্যক্তিকে ১২ অক্টোবর হত্যা করে লাশ প্লাস্টিকের ড্রামে ভরে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ঘটনার ১৮ দিন পর গত ৩০ অক্টোবর বিকেলে নিহতের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন সকালে চান্দহর ইউনিয়নের শান্তিপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কাছ থেকে হত্যার শিকার আবু বক্কর (১৪) অটোরিকসা চালকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত আবু বক্কর ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার কৌলাইল ইউনিয়নের মাসাইল গ্রামের আলম মোল্লার ছেলে। তার খুনের রহস্য পুলিশ এখন পর্যন্ত উদঘাটন করতে পারেনি।
গত ৬ অক্টোবর পৌর এলাকার নয়াডাঙ্গী মহল্লায় ছেলের বউ ও তার প্রেমিকার হাতে খুন হন শাশুড়ি হায়াতন নেছা (৬৫)। গত ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ধল্লা ইউনিয়নের গাজিন্দা বড় পাড়া গ্রামের হজরত আলীকে পূর্ব শক্রতার জের প্রতিবেশীরা পিটিয়ে আহত করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ অক্টোবর মারা যান তিনি। ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ধল্লা পাওয়ার জেনারেশন সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরে তালেবপুর গ্রামে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মুক্তার মিয়া নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
৩ সেপ্টেম্বর ভোরে ধল্লা ইউনিয়নের খাসের চর লাঙ্গুলিয়া গ্রামের পেঁপে ক্ষেত থেকে জবেদ আলী (৪৫) নামের এক কৃষকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৬ অক্টোবর পৌর এলাকার নয়াডাঙ্গী মহল্লায় ছেলের বউ ও তার প্রেমিকার হাতে খুন হন শাশুড়ি হায়াতন নেছা (৬৫)। প্রতিবেশীরা সিন্দুকের ভেতরে রাখা লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশ খবর দেয়। গত ১৩ আগস্ট মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র খুন হয় সায়েস্তা ইউনিয়নের নীলটেক গ্রামের সাদ্দাম হোসেন (৩৫)। তার প্রতিপক্ষ গ্রুপ আওলাদ হোসেন ও সহযোগীরা রাতে রাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। গত ৪ জুন রাতে চান্দহর ইউনিয়নের বাঘুলি গ্রামে প্রতিবেশী মাদকাসক্ত বাবুল ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে বাবুল জিন্নত আলীকে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে একই ইউনিয়নের আটিপাড়া গ্রামে পূর্ব শক্রুতার জের ধরে আব্দুল কুদ্দুস নামের ৩ প্রতিবন্ধীর বাবাকে পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে একই গ্রামের আবুল কালাম ও তার লোকজন। গত ২৮ জানুয়ারি নিজ শয়নকক্ষে খুন হন জামির্ত্তা ইউনিয়নের কাঞ্চননগর গ্রামের সাফিয়া আক্তার লক্ষী। নিজ মানসিক ভাসাম্যহীন ছেলের হাতে খুন হয় বলে জানা গেছে। গত ১০ জানুয়ারি জামসা ইউনিয়নের ছোট বরুন্ডী গ্রামে পরকীয়া প্রেমে বাধা দেয়া ছেলের বউ আইরিন আক্তারের হাতে খুন হয় শাশুড়ি তহুরা বেগম (৫৫)। হত্যাকাণ্ডে বাধা দেয়ায় ঘাতক আইরিনের ছুরিকাঘাতে শ্বশুর আহত হয়। একের পর এক এসব খুনের ঘটনায় এলাকায় আতংক বিরাজ করছে ।
এছাড়া উপজেলা সদর, ঘোনাপাড়া সরকারী হাসপাতাল, জায়গীর বাজার ও মানিকনগর বাজারের দিনদুপুরে একাধিক মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। থানায় এলাকায় অহরহ ঘটেছে দুঃসাহসিক চুরি ঘটনা। উপজেলা গোলাইডাঙ্গা ও বাইমাইল নয়াবাড়ি এলাকায় বছরের শেষের দিকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অনেক পরিবার থেকে সর্বস্ব লুটের ঘটনা ঘটেছে। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড, চুরি- ডাকাতি ও অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের দৌরাত্ম্যরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিররতা থেকে পরিত্রাণ পেতে নতুন বছরে এমনটাই প্রত্যাশা রাজধানীর অতিসন্নিকটে সিংগাইর উপজেলাবাসীর।
সিংগাইর থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন, আমি গত ১২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেয়ার পর অপরাধ প্রবণতা কমেছে। চলমান শীতকালে চুরি-–ডাকাতি নেই বললেও চলে। তার প্রমাণ বছরের শেষ ডিসেম্বরে মামলা সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরাধ নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্ত করতে চান ওসি।
এ ব্যাপারে সিংগাইর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজমুল হাসান বলেন, গত তিন মাস আগে আমার যোগদানের পর দেখলাম খুন ও অপমত্যুর কারণে একের পর এক লাশ উদ্ধার হচ্ছে। প্রত্যেকটি অপরাধের রহস্য উন্মোচনসহ জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অপরাধীদের নির্মূলে মানুষকে সচেতনতায় শতভাগ কাজ করে যাচ্ছি। চুরি, ডাকাতি প্রতিরোধে থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি লোকজন দিয়ে পাহাড়া জোরদার করা হয়েছে।