চৌগাছায় ‘হানি ট্র্যাপ’ চক্রের নারীসহ গ্রেপ্তার ৬

জিয়াউর রহমান রিন্টু, যশোর
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৩ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
যশোরের চৌগাছায় হানি ট্র্যাপ বা ভালোবাসার ফাঁদ প্রতারক চক্রের দুই নারীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- যাত্রাপুরের আলমগীরের স্ত্রী রূপালি খাতুন (৩৫), মনমথপুরের মৃত মান্নানের ছেলে হৃদয় মহিফুল (৩৬) ও দেলোয়ার হোসেন, কয়ারপাড়ার শাহজাহান আলীর ছেলে নান্নু (৩৩) ও তার স্ত্রী জাকিয়া (২৯), মহেশপুর মান্দার বাড়িয়া গ্রামের জাহিদ হোসেন (২৯)।
যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, চৌগাছার রুস্তমপুর গ্রামের হাফিজুর রহমানের ছেলে মোস্তাক হোসেন থানায় অভিযোগ করেন যে, তার ভাই মোঃ আব্দুর রহমানকে প্রলোভনে ফেলে একটি চক্র ‘হানি ট্রাপ’-এর মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে মুক্তিপণ দাবি করছে। অভিযোগের ভিত্তিতে যশোরের পুলিশ সুপার জিয়া উদ্দিন আহম্মেদের নির্দেশে ডিবি পুলিশের একটি দল অভিযানে নামে। ২১ জানুয়ারি চৌগাছার চান্দআফরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে ভিকটিমের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২২ জানুয়ারি রাত ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৩টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের সক্রিয় ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন যশোর শহর থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপজেলায় এই হানি ট্র্যাপ বা ভালবাসার ফাঁদকে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী ব্যবসার হাতিয়ার বানিয়েছে। এবং তাদের সেই ফাঁদে পা দিয়ে শিক্ষক, বিভিন্ন শ্রেনীর ব্যবসায়ী, সাধারণ ব্যক্তি এমনকি পুলিশ সদস্যরাও অসন্মানিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু এতো জানাজানির পরেও কিছু মানুষ ইচ্ছা করেই যেনো হানি ট্র্যাপের শিকার হচ্ছেন। এই হানি ট্র্যাপ বা ভালবাসার ফাঁদে পড়েই গত ২৯ ডিসেম্বর চৌগাছা থানার সাবেক ওসি পায়েল হোসেন এবং ১১ জানুয়ারি একই উপজেলার একজন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন।
জানা যায়, সেই শিক্ষকে গত ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে হানি ট্র্যাপের শিকার হয়ে উপজেলার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা আরো টাকার দাবি করলে সেই শিক্ষক টাকা দিতে অস্বীকার করেন। তখন সন্ত্রাসীরা তার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে। উপজেলাতে বর্তমানে মেয়েদের পাশাপাশি এক শ্রেনীর কুরুচিপূর্ণ ছেলেদেরকেও হানি ট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করছে। এই ছেলেরা স্বচ্ছল ও ধনী পরিবারের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া মেয়েদেরকে প্রেমের অভিনয়ে ফাঁসিয়ে অশ্লিল ভিডিও বানিয়ে তার পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করছে। এবং সেই পরিবারকে সামাজিকভাবে অপমানিত করার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিও করছে।
অন্যদিকে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় ভোরের কাগজের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী সরকারের সময়েই (২০১৮ সালের মাঝামাঝি) এই প্রতারক চক্রের আবির্ভাব ঘটে। সেসময় চৌগাছা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা বিশ্বাস ওরফে মোস্তর নেতৃত্বে বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা এই প্রতারক চক্র পরিচালনা করতো। বিভিন্ন বয়সের মেয়েদেরকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে তারা স্বচ্ছল ব্যক্তিদেরকে শিকারে পরিণত করতো। প্রথমে নারী সদস্যরা শিকারকে লোভ দেখিয়ে নিজস্ব ডেরায় নিয়ে আসে। সেখানে মাদক সেবন, অশ্লীল নাচ গানের সঙ্গে সঙ্গে শিকারকে যৌনতায় আকৃষ্ট করা হয়।
এসকল ঘটনা আস্তানায় প্রবেশ থেকে সকল ঘটনাই গোপন ক্যামেরায় ধারণ হতে থাকে। এরপর যৌনতার এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীদেরকে মোবাইলের মাধ্যমে সংকেত পাঠানো হলে তারা এসে শিকারকে সেই মহিলাসহ ধরে ফেলে। সেসময় কেউ বাধা দিলে চলে নির্মম নির্যাতন। কাউকে কাউকে সন্ত্রাসীরা তাদের টর্চার সেলেও নিয়ে যায়। সেখানে তাকে উলঙ্গ করে যৌনাঙ্গে ইট ঝুলিয়ে অথবা উপরের দিকে দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হয়।
আবার কখনো জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন দিয়ে ছ্যাকা দেয়া হয়। নির্যাতনের আগে বা পরে সেই নারীসহ তাকে উলঙ্গ বা অর্ধ্ব উলঙ্গ অবস্থায় ঘটনার বিস্তারিত শিকারের মুখ থেকে বক্তব্য আকারে ভিডিও করে সংরক্ষণ করা হয়। এরপরেই তাকে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। তারপরেও সুবিধা না হলে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে তাদেরকে জনসন্মুখে অসন্মানিত করা হয়।
সূত্র বলছে, বর্তমানে উপজেলাতে যে কয়েকটি চক্র রয়েছে তার মধ্যে বিশ্বাসপাড়ার বাবু ওরফে চোর বাবুর চক্রটি বেশ বড়। এছাড়াও আরো কয়েকটি চক্র রয়েছে। চক্রের কেউ কেউ আবার পুলিশের দালাল হিসেবেও পরিচিত। এছাড়া চক্রের সকলেই সর্বদা ক্ষমতাসীন দলের লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। যেকারণে সহজে কেউ তাদের বিরুদ্ধাচারণ করে না। তবে এই ৬ জনের গ্রেপ্তারে উপজেলাবাসী যশোর পুলিশ সুপার এবং গোয়েন্দা পুলিশকে সাধুবাদ জানিয়ে এই সকল প্রতারক চক্রের সকলকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছেন।