প্রতিমাসে ব্যাংকের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নিতেন আলাউদ্দিন নাসিম

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৬ পিএম

জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ছবি : ভোরের কাগজ
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে যেসব খাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে তার মধ্যে বিদ্যুৎখাত অন্যতম। এর নেতৃত্বে যিনি ছিলেন তিনি সব সময়ই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াই শেখ হাসিনা ও রেহানার নাম ভাঙিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক বনে গেছেন। কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে মালিক সেজে প্রতিমাসে ঘুষের টাকা নিয়েছেন ব্যাংকের মাধ্যমে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার ও শেখ রেহানার ফান্ড কালেক্টর আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজন হিসেবে বিনা পুঁজিতে ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প থেকে বিদেশে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।
ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, সংবাদ মাধ্যমে ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক বলা হলেও এস আলমের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেডের মালিকানায়ও নাসিম রয়েছেন। প্রতিমাসে ব্যাংকে এসএস পাওয়ার থেকে মোটা অংকের টাকা নাসিম এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ডা. জাহানারা আরজু এর নামে জমা হতো।
এমন একটি মোটা অঙ্কে টাকার চেকের কপি সংবাদমাধ্যমের হাতে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার থাকাকালীন মিস্টার টোয়েন্টি পার্সেন্ট হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত লাভ করেছিলেন আলাউদ্দিন নাসিম। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে ব্যবসায়ীরা টেন্ডার পেতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির কারণে অনেকেই ধরা পড়লেও সব সময় অন্তরালে থেকে যেতেন দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত আলাউদ্দিন নাসিম।
বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী এই সাবেক এমপিকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনো রকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন এক আলোচিত ব্যবসায়ী। তাকে সামনে রেখেই চালানো হয় লুটপাট।
আরো পড়ুন : মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাজা গ্রেপ্তার
তার নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির খবর প্রচারিত হওয়ায় নড়ে চড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করায় গত বছরের ২ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ফেনীর সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের সম্পদের অনুসন্ধান করছি। তার অনেক সম্পদের তথ্য পাচ্ছি। আমরা তার বিষয়ে সার্বিকভাবে খোঁজখবর নিচ্ছি। আগামী ১ মাসের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করব।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নাসিম হয়ে উঠেন অঘোষিত গডফাদার। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে রাঘববোয়াল হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। গত ১৭ বছরে তিনি অবৈধ উপায়ে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। তিনি সাবেক আমলা ও শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার ছিলেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাসিম গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীকে নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, বিএনপি নেতাকর্মী এবং জামায়াতের নেতাকর্মীদের জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। দখল বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং সরকারি টেন্ডার বাণিজ্য করে অবৈধ উপায়ে শত কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগও রয়েছে।
আলাউদ্দিন নাসিম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগ আওয়ামী লীগের অভিভাবক। তার সক্রিয় ভূমিকায় চলতো বৃহত্তর নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের প্রশাসন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অন্য মন্ত্রী-এমপিদের মতো আলাউদ্দিন নাসিমও আত্মগোপনে চলে যান।
জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকায় রয়েছে আলাউদ্দিন নাসিমের মদের গুদাম। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মদের গুদাম বলে আলোচিত। এছাড়া বিভিন্ন ক্লাব থেকে সদস্যদের জন্য কম দামে কেনা মদ তিনি বেশি দামে বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরো পড়ুন : সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুমকি ও জাকিরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনের তারিখ নির্ধারণ
স্থানীয়দের মতে, এমপি ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে বেনামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ। এছাড়াও কানাডায় রয়েছে বাড়ি গাড়ি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রভাবশালী এই সাবেক এমপিকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনো রকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন এক আলোচিত ব্যবসায়ী।
ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি আলাউদ্দিন নাসিম। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ফেনীজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে নাসিম এখন কোথায়? ফেনীতে নাসিমের নামে তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। আলাউদ্দিন নাসিমের নির্দেশেই ফেনীতে ছাত্র-জনতাকে গুলিতে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশে জুলাই ও আগস্ট মাসে ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে চলে ছাত্রহত্যা।