জাবিতে ছাত্রলীগ-আন্দোলনকারী-পুলিশ ত্রিমুখী সংঘর্ষে অধ্যাপক এলাহি গুরুতর আহত

তানভীর ইবনে মোবারক, জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৮ পিএম

জাবিতে ছাত্রলীগ-আন্দোলনকারী-পুলিশ ত্রিমুখী সংঘর্ষে অধ্যাপক এলাহি গুরুতর আহত। ছবি: সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ফের সশস্ত্র হামলা করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর। সোমবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যা ৭ টায় কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিলে একদফা হামলার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আশপাশের এলাকা থেকে ট্রাকে করে বহিরাগত লোকজন ভাড়া করে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এই হামলার নেতৃত্ব দেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল। রাত বারোটার দিকে অন্তত ৩০০ জন হেলমেট পরিহিত হামলাকারী হাতে দেশীয় অস্ত্র, ককটেল, পেট্রোল বোমা নিয়ে ভিসির বাসভবনের বাইরে অবস্থান নেয়। এসময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করেন হামলাকারীরা।
১৬ জুলাই রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বহিরাগত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে উপাচার্যের বাসভবনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাথাড়ি হামলা চালায়। এসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর লাঠি ও রামদা নিয়ে হামলা চালানো হয়।
হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা জানায় প্রথমে বাইরে থেকে তাদের ওপর ইট-পাটকেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পরে হামলাকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আমাদের ওপর রামদা ও লাঠি নিয়ে হামলা চালায়। এসময় নারী শিক্ষার্থীরাও হামলাকারীদের আক্রমণের স্বীকার হয়। এই আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি কর্তব্যরত সাংবাদিকরাও।
কর্তব্যরত সাংবাদিকরা তাদের পরিচয় দিলেও প্রায় সবার ওপর হামলা চালানো হয়। এসময় অনেকে দৌড়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় চাইলেও পুলিশের সামনেই তাদেরকে বেধড়ক পিটুনি দেয়া হয়।
হামলায় আহত হন জাবির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের শিক্ষার্থী এবং সাউথ এশিয়ান টাইমসের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি, বনিক বার্তার ক্যাম্পাস প্রতিনিধিসহ একাধিক কর্তব্যরত সাংবাদিক ।
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান হামলায় আহত হয়েছে তাদের অন্তত একশোরও বেশি শিক্ষার্থী।
আহত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর আগে থেকেই এই হামলার খবর জানতো। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে তারা কিছুই করেনি। আমরা হামলা থেকে বাচতে উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছি আর বাইরে থেকে এসে আমাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছে। যারা তাদের শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মুখে রেখে নিজেরা ভেতরে লুকিয়ে থাকে। আমরা এইরকম প্রক্টর চাই না, এরকম অভিভাবক আমাদের দরকার নেই। শিক্ষার্থীরা এভাবেই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
হামলার খবরে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে জিম্মিদের উদ্ধারে ভিসির বাসভবনের দিকে এগোও। পরে সেখানে শিক্ষার্থী-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয় শতাধিক। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাত পৌনে ৩ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে ৩ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ভোর ৪টা নাগাদ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে।
এর আগে রাত পৌনে ৩ টার দিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল এলাহি মারাত্মকভাবে আহত হন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে আহত হন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন। এছাড়া রাতভর সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় সাংবাদিকসহ ৪ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদেরকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সোমবার রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলমের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা), সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, প্রক্টর এবং বিভিন্ন হলের প্রভোস্টদের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলার বিষয়ে কথা বলতে যান। এসময় উপচার্য ১৫ মিনিট পরে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে বাসায় ভেতরে প্রবেশ করার পরপরই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে আসলে মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
এই ঘটনায় আহত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং নারী শিক্ষার্থীসহ অন্তত অর্ধ-শতাধিক। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে জড়ো হতে থাকে। এরপর একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী হাসিব জামান বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করছিলাম। মিছিলে ছাত্রলীগ আমাদের ওপরে অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের এই হামলায় আমাদের একজন শিক্ষক পর্যন্ত আহত হয়। এই সময় প্রোক্টোরিয়াল টিম এবং কোনো নিরাপত্তা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে সন্ত্রাসীদের এনে আমাদের উপরে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য যেহেতু সর্বোচ্চ অভিভাবক এজন্য আমরা তার কাছে বিচারের দাবিতে গিয়েছি।
আরো পড়ুন: কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় অ্যামনেস্টির বিবৃতি