দর্শন থুগুদীপা: ভারতীয় সিনেমার সুপারস্টার নায়ক কিন্তু বাস্তবে ভয়ঙ্কর খুনি

এমএ সায়েম
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৪:০৬ পিএম

দর্শন থুগুদীপা: ভারতীয় সিনেমার সুপারস্টার নায়ক কিন্তু বাস্তবে ভয়ঙ্কর খুনি
আসল নাম হেমন্ত কুমার। যিনি ভারতের কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত দর্শন নামে। কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বেশি আয় করা তারকা হিসেবে বিবেচিত দর্শন থুগুদীপা প্রায় ৬০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয়টি মানুষের কাছে ব্যাপ্তি পেয়েছে তা হচ্ছে, সে একজন ভয়াবহ নিষ্ঠুর খুনি, যে কিনা নিজেরই একজন ভক্তকে অমানবিক অত্যাচার করে হত্যা করেছে।
সম্ভবত দর্শনই পৃথিবীর একমাত্র অভিনেতা যার হাতে নিজের ভক্ত খুন হয়েছে। তাও কোনো অনিচ্ছাকৃত হত্যা নয়; রীতিমতো পৈশাচিক অত্যাচার করে করে খুন। খুন হওয়া ভক্ত রেনুকা স্বামীকে মেরে থুতনি, হাত পায়ের হাড়গোড়, মাথার খুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল যৌনাঙ্গ, কেটে নেওয়া হয়েছিল জিভ ও কান।
৩৩ বছরের রেনুকা চাকরি করতেন একটি ওষুধের দোকানে। গত ৯ জুন বেঙ্গালুরুতে সুমনাহাল্লি ব্রিজের পাশে একটি ড্রেনের ধার থেকে উদ্ধার হয় ৩৩ বছর বয়সী রেণুকা স্বামীর মৃতদেহ। পুলিশ জানিয়েছে, দর্শন তার চিত্তদুর্গার ফ্যান ক্লাবের রঘুবেন্দ্র ওরফে রঘুকে রেণুকা স্বামীর বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছিলেন। রেণুকা স্বামীর স্ত্রীও জানিয়েছেন রঘুই তাকে অপহরণ করে নিয়ে যান। প্রসঙ্গত, এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয় এবং রেনুকার স্ত্রী বর্তমানে গর্ভবতী।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ অবশ্য এই খুনের কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছিল না। কারণ রেনুকা একজন সাধারণ ভাল মানুষ ছিল এবং তার সঙ্গে কারো শত্রুতাও ছিল না। এরমধ্যে ১০ জুন বিকেলে রঘুসহ আরও ২ জন পুলিশ স্টেশনে এসে বলে তারা টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় রেনুকাকে খুন করে, এখন ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করতে চায়।
কিন্তু তাদের কথাবার্তা সন্দেহজনক লাগায় পুলিশ আলাদা আলাদা করে তাদের জেরা করে এবং তাদের কল রেকর্ড চেক করে। জেরায় দেখা যায় যে তাদের একজনের কথা আরেকজনের সঙ্গে মিলছে না। কিন্তু একটা বিষয় পুলিশের নজরে আসে যে তারা তিনজনই একটা কমন নম্বরে কথা বলেছে গত দুদিন, যেটি ছিল দর্শনের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর।
কিন্তু কেন দর্শন একজন সাধারণ ভক্তকে খুন করলো? ঘটনার সূত্রপাত হয় দর্শনের পারিবারিক জীবন থেকে। স্ত্রী-পুত্র থাকার পরেও দর্শনের বিবাহ বহির্ভূত প্রেম আছে পবিত্র গৌড়া নামক একজন মডেল, ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে। এই পরকীয়ার গোপন সম্পর্কটি ১০ বছর ধরে চলছিল, তাদের একটা মেয়েও রয়েছে।
কিন্তু ২০২৩ সালে পবিত্রা সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করে মেয়ে খুশির জন্মদিনে যেখানে দর্শনকেও দেখা যায়। সেই পোস্টটি টেনে দর্শনের স্ত্রী বিজয়লক্ষী পবিত্ৰা গৌড়াকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি এই মহিলাকে অন্য কারও স্বামীর ছবি পোস্ট করার আগে তার জ্ঞানে আসতে হবে, লোকটি বিবাহিত। কিন্তু এখন মনে হয় আমার আওয়াজ তোলার সময় এসেছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেব।”
এরপরে দর্শনের সঙ্গে আরও রিল পোস্ট করে পবিত্রা। এসব দেখে ভক্তরা নাখোশ হন দর্শনের ওপর, পবিত্রার কারণে ঘর ভাঙাটা ভাল লাগেনা অনেকের। এদের মধ্যে একজন ছিলেন রেনুকা। সে একটা ফেইক ইন্সটাগ্রাম আইডি খুলে রেনুকাকে দোষী এবং খারাপ চরিত্রের মহিলা বলে ম্যাসেজ, কমেন্ট করতে থাকে।
ক্রমাগত এইসব খারাপ কথা শুনে রেগে গিয়ে দর্শনের কাছে বিচার দেয় রেনুকা। বান্ধবীকে খুশি করতে গিয়েই ফেইক প্রোফাইলটি কার খুঁজে বের করে দর্শন এবং তুলে আনে রেনুকাকে। রাঘবকে দিয়ে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজটি করায় দর্শন। বেঙ্গালুরুতে তুলে এনে বেঁধে রাখা হয় তাকে। দর্শনের বান্ধবী পুলিশের কাছে রিমান্ডে থাকাকালীন চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, ৩৩ বছর বয়সী রেনুকাকে প্রথমে জুতো দিয়ে আঘাত করেছিলেন। পরবর্তীতে অন্যরাও চড়াও হয়। রড দিয়ে পিটিয়ে, নানাপ্রকার মারধর করে এবং কারেন্টের শক দিয়ে হত্যা করে দর্শন এবং তার লোকেরা। এই মামলায় এখন অব্দি ১৭ জন অভিযুক্ত হয়েছে, ১১ জন হয়েছে গ্রেফতার। জেলে আছে দর্শন।
শুধুমাত্র এই ঘটনাই একমাত্র নয়, এর আগেও নানাপ্রকার সন্ত্রাসী কাজকর্ম করেছে দর্শন। মাইসুর হোটেলে একজন ওয়েটারকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, ২০২২ সালে একজন কন্নড় চলচ্চিত্র প্রযোজকে ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেওয়া, কুকুর লেলিয়ে প্রতিবেশীকে আক্রমণ, স্ত্রীকে মারধর এবং রিভলভার প্রদর্শন ইত্যাদি অপরাধের জন্য পুলিশের কাছে অভিযোগ আছে দর্শনের নামে, ছিলেন কারাগারেও।
আর এই সবের মাঝেই প্রকাশ্যে এসেছে আরও একটি ঘটনা। দর্শনের ফার্মহাউসের সামনে থেকে উদ্ধার হয়েছে অভিনেতার ম্যানেজারের মৃতদেহ। পুলিশ বলছে, আত্মহত্যা করেছেন দর্শনের ম্যানেজার শ্রীধর। বেঙ্গালুরুর ফার্মহাউসেই আত্মঘাতী হন। ঘটনাস্থলে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, ভিডিও ম্যাসেজে আত্মহত্যার কারণও ব্যাখা করেছিলেন দর্শনের ম্যানেজার।
একাকীত্বে ভুগছিলেন, যার জন্যই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। ভিডিও বার্তায় আরো বলেছেন, এই বিষয়ে যেন তার পরিবারের উপর যেন কোনও চাপ সৃষ্টি না করা হয়। সিদ্ধান্তটা তার একান্ত ব্যক্তিগত। পুলিশ সেই ঘটনার তদন্ত করছে। রেণুকা স্বামীর হত্যার সঙ্গে কোনও যোগ আছে কিনা। এই ঘটনার সঙ্গে দর্শন জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, কন্নড় অভিনেতার প্রাক্তন ম্যানেজার মল্লিকা অর্জুনও ২০১৮ সাল থেকে বিগত প্রায় ছয় বছর ধরে নিখোঁজ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দর্শনের নামে মোটা টাকা আদায় করতেন। অভিনেতা অর্জুন সারজার কাছ থেকে দর্শনের নাম করে এক কোটি টাকা নিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই ম্যানেজার-অভিনেতার সম্পর্কে চিড় ধরে। এরপরই আশ্চর্যজনকভাবে মল্লিকা অর্জুনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
পুলিশের তদন্তে এসব বিষয়ে সামনে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।