সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা জোলানির অতীত-বর্তমান

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৯ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো গত সপ্তাহে চোখের নিমিষে বিদ্রোহীরা করায়ত্ত করে নেয়। এরপর বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) আলেপ্পোর দক্ষিণের হামা শহরও তারা দখলে নিয়েছেন। এখন তারা আরো দক্ষিণের হোমস শহরের নিকটে চলে এসেছেন। এটি সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর। রাজধানী দামেস্ক থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি দূরে নয়। বিদ্রোহীদের আকস্মিক অগ্রযাত্রায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, তার প্রধান মিত্র রাশিয়া ও ইরান বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ, ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় গত কয়েক বছরে বেশ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। এখন তা তাসের ঘরের মতো তছনছ হতে শুরু করেছে।
এবার বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। ছোট ছোট আরো কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ে তিনি জোট করেছেন। তবে এইচটিএস-ই সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাই জোলানিকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এ বিদ্রোহী নেতার অতীত-বর্তমান অল্প বিস্তর তুলে ধরা হলো। এইচটিএসের প্রতিষ্ঠাতা জোলানি প্রায় এক দশক আগে থেকে সিরিয়ার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। অন্য গোষ্ঠীগুলো আশপাশের কয়েকটি দেশে অভিযান অব্যাহত রাখলেও তিনি নিজেকে এ ধরনের কাজ থেকে গুটিয়ে নেন। এই সবকিছুর বদলে তিনি সিরিয়ায় একটি ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেন।
২০১৬ সাল থেকে জোলানি ও তার গোষ্ঠী এইচটিএস আসাদ সরকার থেকে স্বাধীন করা সিরিয়ার ভূখণ্ডে নিজেকে বিশ্বযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এইচটিএস ২০১৭ সালে সিরিয়ান স্যালভেশন গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে তারা দেশটির ইদলিবে প্রশাসন পরিচালনা করছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সেখানকার বেসামরিক প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত, বিচার বিভাগ, অবকাঠামো, অর্থ খাত ও অনুদান বিতরণসহ নানা কাজ পরিচালনা করছে। তবে এইচটিএস চরমপন্থী গোষ্ঠী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। অধিকারকর্মী, সংবাদ প্রতিবেদন ও স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, তারা কঠোর হাতে শাসন করে, বিরোধীদের সহ্য করে না।
স্বাধীন সাংবাদিকতা-বিষয়ক সংগঠন সিরিয়া ডিরেক্টের মতে, অধিকারকর্মীদের গুম হওয়ার পেছনে এইচটিএসের হাত রয়েছে। তারা বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর গোলাবারুদ নিক্ষেপ করেছে। আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির আসল নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। ১৯৮২ সালে তিনি সৌদি আরবের রিয়াদে জন্ম নেন। তখন তার বাবা সেখানে পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে। দামেস্কের অদূরে বসতি স্থাপন করে।
দামেস্কে থাকাকালে জোলানি কী করতেন, তা জানা যায় না। ২০০৩ সালে সিরিয়া থেকে ইরাকে এসে তিনি আল-কায়েদায় যোগ দেন। এই বছরই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়। তিনি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। তখন থেকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে জোলানি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর আটক থাকেন। অর্থাৎ ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি ছাড়া পান। এরপর তার নেতৃত্বে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, বিশেষত ইদলিবে শক্তিশালী হতে থাকে। প্রথম দিকের কয়েক বছর জোলানি আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে কাজ করেন। বাগদাদি ছিলেন ইরাকের ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি পরে আইএসআইএল (আইএসআইএস) নাম ধারণ করে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বাগদাদি আকস্মিকভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সিরিয়ায় নিজেদের তৎপরতা বাড়াতে কাজ শুরু করেন। একটা পর্যায়ে আইএসআইএল আল-নুসরা ফ্রন্টকে বেশ ভালোভাবে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। তখনই আইএসআইএলের জন্ম হয়। জোলানি এ পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। এ অবস্থায় ২০১৪ সালে আল–জাজিরাকে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন জোলানি। এতে তিনি বলেছিলেন, তার গোষ্ঠী ‘ইসলামিক আইনের’ যে ব্যাখ্যা দেবে, সিরিয়া সেই অনুযায়ী শাসিত হবে।
কয়েক বছর পর জোলানির মধ্যে পরিবর্তন আসে। তিনি আল-কায়েদার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় ‘বিশ্বব্যাপী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে সরে আসেন। এমন কিছুর পরিবর্তে সিরিয়া সীমান্তের ভেতরে নিজের গোষ্ঠীর তৎপরতা সীমাবদ্ধ করেন জোলানি।
জোলানির এ পরিবর্তনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে জোলানির গোষ্ঠীটি বহুজাতিক বা আন্তদেশীয় গোষ্ঠীর বদলে একটি জাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বাশার সরকার আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ইদলিবের দিকে চলে যায়। সিরিয়ার এ অঞ্চলটি এখনো বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। ওই সময়টাতে জোলানি আল-নুসরা ফ্রন্টের নাম পরিবর্তন করে জাভাত ফাতেহ আল-শাম রাখেন।
২০১৭ সালের শুরুর দিকে আলেপ্পো থেকে হাজার হাজার যোদ্ধা ইদলিবে পালিয়ে আসেন। এ সময়ে বিদ্রোহীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু গোষ্ঠী ও নিজের জাভাত ফাতেহ আল-শাম নিয়ে এইচটিএস গঠন করেন জোলানি। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মতে, এইচটিএসের ঘোষিত লক্ষ্য হলো, আসাদের শাসন থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা। দেশটিতে ‘ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা’। নিজেদের দেয়া ‘ইসলামি আইনের’ ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
আলেপ্পোর পর হামা শহর দখলে নেয়ার পর বিদ্রোহীরা এখন আরো দক্ষিণে, তথা রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। উদ্ভূত এই নতুন পরিস্থিতিতে জোলানি সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এনেছেন। তিনি এখন তাদের সিরিয়ায় রাখার পক্ষে। আলেপ্পো করায়ত্ত করার পর এইচটিএস ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হবে বলে বলেছেন। সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হাসান বলেন, জোলানি এইচটিএসকে সিরিয়ার বিশ্বাসযোগ্য শাসক হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। পাশাপাশি গোষ্ঠীটি নিজেদের বিশ্বের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের সম্ভাব্য অংশীদার করতে চায়।
সিএসআইএসের তথ্যমতে, ইদলিবে জোলানি এরই মধ্যে অন্যান্য সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হারাকাত নুর আল-দিন আল-জিনকি, লিওয়া আল-হক এবং জায়েশ আল-সুন্নার সঙ্গে অংশীদারি গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। আগের মিত্র হুররাস আল-দিনের মতো সিরিয়ার নতুন আল-কায়েদার শাখার সঙ্গে সম্পর্ক এড়াতেই তিনি অন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অংশীদারি গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। জাতিসংঘ, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এইচটিএসকে বর্তমানে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন মনে করে। জোলানি তার গোষ্ঠীকে এখনো সন্ত্রাসী বলাটা ঠিক নয় বলে মনে করেন। কারণ, তারা আগের সম্পৃক্ততা পরিত্যাগ করে নিজেদের জাতীয় বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করেছে।জোলানি সিরিয়ায় কী করতে চান, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এই সবকিছু ছাড়িয়ে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে এইচটিএস এরই মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে। এ গোষ্ঠীটির প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী হবে বলে মনে করা হচ্ছে।