এবার প্রতিমা বিসর্জনে ঘটল না দুই বাংলার মিলনমেলা

এস আর সেলিম, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) থেকে
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০১ এএম

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের ওপারে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভিড়
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জনে এবার ঘটেনি দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা।
সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে সুবিধা করে উঠতে পারেননি বিজয়া দশমীকে ঘিরে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে আসা দুই বাংলার মানুষ।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এপার বাংলার মানুষ মাথাভাঙ্গার আশপাশে ভিড়তেই পারেননি। ফলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে আসেন সীমান্তে জড়ো হওয়া মানুষজন।
এপারে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ সীমান্ত আর ওপারে ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার শিকারপুর সীমান্ত। দুই বাংলার মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে পদ্মার শাখা নদী মাথাভাঙ্গা। এই নদীতে প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর এখানে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা ঘটে।
কিন্তু এবার দেখা গেল এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ঘটনা। ওপার বাংলায় থাকা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা তো পরের কথা দূর থেকে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতে পারেননি এপার বাংলার মানুষেরা। এ কারণে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা এর আগে কখনো এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি বলে জানান।
রোববার (১৩ অক্টোবর) বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। এ উপলক্ষে দুপুর থেকেই দৌলতপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববতী জেলা মেহেরপুর ও পাবনা থেকে প্রতিবছরের মতো বহু মানুষ মাথাভাঙ্গার উদ্দেশে সীমান্তমুখি হতে থাকেন। কিন্তু বাধ সাধে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
তাদের কড়াকড়ি অবস্থানের কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হওয়া মানুষজনকে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যেতে হয়। এপারে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা যেমন কঠোর অবস্থানে ছিলেন, ওপারেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা একইভাবে সতর্ক অবস্থায় ছিলেন। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে মাথাভাঙ্গায় আসেন, প্রতিমা বিসর্জন দেন।
সূত্র মতে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই সীমান্তে কড়াকড়ি অবস্থা জারি করে বিজিবি। এ রকম এক কঠোর পরিস্থিতির মাঝেই এ বছর সামনে আসে শারদীয় দুর্গোৎসব। অনেকে প্রতিমা বিসর্জনের এই দিনটির জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। বছর ঘুরে আসা এই দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন দুই বাংলার মানুষজন।
তারা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে এক বিকালের কিছু সময়ের জন্য দূর থেকে দেখা করার সুযোগ পান। তারা সরাসরি মুখোমুখি হতে না পারলেও ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে একে অপরের খোঁজখবর নেন।
কেউ আবার নদী সাঁতরে স্বজনদের একটু ছুঁয়ে দেখেন, আবেগে চোখের জল ফেলেন, মিষ্টি দেন। কিন্তু এ বছর উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এ কারণে এপার বাংলার মানুষজন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান।
সীমান্ত আসা কয়েকজন নারী-পুরুষ জানান, প্রতিবছর প্রতিমা বিসর্জনের দিনে তারা ওপার বাংলায় থাকা আত্মীয়স্বজনদের সাথে দূর থেকে হলেও দেখা করার জন্য ছুটে আসেন।
মাথাভাঙ্গাকে সামনে রেখে নদীটির দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে তারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও কুশল বিনিময় করেন। কিন্তু এ বছর তাদের সেই আশা পূরণ হলো না।
আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা মাথাভাঙ্গার কাছে তাদের ভিড়তেই দেয়নি বিজিবি। এই প্রথমবারের মতো এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখে পড়তে হলো তাদের। এ কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন অনেকে। তারা বলেন, বিজিবি কড়াকড়ির নামে অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন।
বিজিবি জানায়, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এবার সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বিজিবির এই কড়াকড়ি অবস্থান। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষকে বিজিবির বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করতে দেয়া হয়নি।
রোববার বিকাল থেকেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিকারপুর সীমান্ত এলাকার পুজামণ্ডপগুলো থেকে বেশ কয়েকটি প্রতিমা আসতে থাকে মাথাভাঙ্গায়। বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঢাকের তালে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সেখানে প্রতিমা নিয়ে জড়ো হন।
প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দূর্গোৎসব। ভক্তদের চোখের জলে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে কৈলাসে ফিরে যান দেবী দূর্গা।
মাথাভাঙ্গা নদীতে ওপার বাংলার প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হলেও এবার বাংলার কোনো প্রতিমা থাকে না। এপার বাংলার মানুষ শুধুমাত্র আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্যই মাথাভাঙ্গায় ভিড় জমান। এতে প্রতিবছর দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ সীমান্তের মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।