দেশের জন্যে কাজ করে জীবনটা অর্থবহ হয়েছে

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:১২ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ






বাঙালি জাতি স্বত্ত্বাকে ধারণ করে শুদ্ধ বাঙালি হওয়ার ব্রত নিয়ে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এখনও সচল ও সক্রিয়। তার হাতে গড়া ছায়ানট, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ও নালন্দা বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সুস্থ ধারা এবং মানবিক সমাজ গড়ায় আগ্রহী। তিনি সন্জীদা খাতুন।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট মিলনায়তনে এসে সংস্কৃতিজনরা নবতীপূর্ণা সন্জীদা খাতুনের ৯১তম জন্মদিনের আয়োজনে এসে শংসাবচনে এভাবেই তুলে ধরেন এ কীর্তিময়ীর জীবনগাথা।

শৈশবের এক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে সন্জীদা খাতুন বলেন, আমার জীবনের নব্বইটি বছর পার হয়ে গেল। আজ ভাবতে বসেছি, জীবনটাকে আমি কী রকম করে সাজাতে চেয়েছিলাম আর বাস্তবে কী হয়েছে।
ছেলেবেলায় ইজিচেয়ারের বাতিল হয়ে যাওয়া কাপড় বিছিয়ে নানীর দেখাদেখি নামাজের ভঙ্গি করতাম। আর কিছুই জানা ছিল না বলে মুখে ‘আল্লা আল্লা’ বলতে থাকতাম। মোনাজাতে অনেক কিছু চাইতাম আল্লার কাছে। কিছুদিন পরেই মনে ধিক্কার এলো নিজের জন্যে এটা ওটা চাইব কেনো? ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে অন্য সবার মঙ্গল কামনায় মোনাজাত করতে আরম্ভ করলাম। সেই থেকেই সবার ভালো চাইবার দিকে মন গেল। আমার মা ভিখারিকে কিছু দেবার কাজটি আমাদের দিয়ে করাতেন। বলতেন, তাতে গরিব মানুষদের প্রতি আমাদের মনে মায়ামমতা জন্মাবে। এ শিক্ষা মানুষকে ভালোবাসবার মানসিকতা গড়ে দিয়েছিল বাল্যকাল থেকে।

গানের সুর আর ছন্দ আমাকে আবাল্য মোহিত করেছে। শেষ বিকেলে দক্ষিণের বারান্দায় পাটি পেতে বড়দি গান গাইতে বসতেন। নানা ধরণের গান। আমার আকর্ষণ ছিল একটি গানে, ‘তৃষ্ণার জল এসো এসো হে’। অপেক্ষা করতাম বড়দি কতক্ষণে গাইবেন- ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্ / ভেদ করো কঠিনের ক্রুর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্। এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে, এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্।’

কথাপ্রসঙ্গে ছায়ানটের ‘শ্রোতার আসর’; গানের শিক্ষা, সাধনা আর প্রসারে কাজ, আরও পরে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ গঠন ও নালন্দার যাত্রার ইতিহাস টেনে সন্জীদা খাতুন বলেন, বছর পাঁচেক বয়সে বড়দির ওস্তাদজি প্রসিদ্ধ ঠুমরি গায়ক মহম্মদ হোসেন দাদুর কাছে গানের হাতেখড়ি হয়েছিল। ক্রমে গান শিখলাম, গাইলাম। রেডিওতে, পরে টেলিভিশনে। তারপর ছায়ানটের ‘শ্রোতার আসর’ করতে গিয়ে দেশে সঙ্গীতশিল্পীর অভাব টের পেলাম। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ‘ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন’ শুরু হলে, তার সঙ্গে যুক্ত হলাম। গানের শিক্ষা, সাধনা আর প্রসারের কাজে আগাপাশতলা সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। এ আন্দোলনের আনন্দ জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে ছাড়িয়ে গেল। এই ধারাতেই আরো একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হলো কিছুকাল পরে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ্’-এর অন্তত ত্রিশ/পঁয়ত্রিশটি শাখায় ঘুরে ঘুরে, কখনো-বা ঢাকাতে শাখা প্রতিনিধিদের ডেকে এনে সঙ্গীতশিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে সঙ্গীতের সম্প্রসারণ ঝটিকাগতি পেল।

ছায়ানট মিলনায়তনে তখন পিনপতন নীরবতা। মুগ্ধ শ্রোতা তন্ময় তখন নবতিপূর্ণা কথনে সন্জীদা খাতুন বলেন, সেই- যে ছেলেবেলায় সবার মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা তা পূর্ণ হতে পেরেছে এইভাবে। শিশুদের জন্যে, দেশের জন্যে বাঙালি জাতির জন্যে কাজ করে আমার জীবনটা অর্থবহ হয়েছে বলে মনে করি। অল্পে তুষ্ট সহজ-সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।
কথন পর্বে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, আজ সন্জীদা খাতুন, আমাদের প্রিয় মিনু আপার নব্বই বছর পূর্ণ হলো। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, বয়সের কারণে দেহ কিছুটা অসমর্থ হলেও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তিনি সচল ও সক্রিয় রয়েছেন। মুক্তচিন্তা ও সঙ্গীতের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্জীদা খাতুন সর্বজন যেন বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানব হয়ে ওঠে, তার সাধনা করে চলেছেন। স্থির প্রত্যয়ের এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। কিন্তু, তিনি লক্ষ্য অর্জনে সর্বদা আপন সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছেন।

অভিজিৎ কুণ্ডুর কণ্ঠে ধ্রুপদ সংগীতে শুরু হওয়া জন্মদিনের এ আয়োজনে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফাহমিদা খাতুন, চন্দনা মজুমদার, শারমিন সাথী ইসলাম, ইফফাত আরা দেওয়ান, লাইসা আহমেদ লিসা, ফারহানা আক্তার শার্লি, সুমন মজুমদার। ছায়ানটের মনিপুরীও ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পীরা মঞ্চে পরিবেশন করেন এদিন। ছিলো ছায়ানটের শিশু শিল্পীদের কণ্ঠে সম্মেলক সংগীত পরিবেশনা।

সন্জীদা খাতুনের জন্ম ৪ এপ্রিল ১৯৩৩ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে।