আসাদের পতনের পেছনের মাস্টারমাইন্ড কে এই জুলানি?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১০ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং সর্বশেষ সহিংসতার মাত্র ১২ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারিগর হিসেবে আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির নাম উঠে এসেছে। তিনি হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে শুধু সামরিক অভিযানগুলো পরিচালনাতেই নয়, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। আসাদ সরকারের পতন নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে, তখন জুলানির পরিচয় ও তার কৌশল নিয়ে আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির পরিচয়
৪২ বছর বয়সি আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির প্রকৃত নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। তিনি ১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে সিরিয়া চলে আসেন। তার পূর্বপুরুষরা গোলান মালভূমিতে বসবাস করতেন, যা বর্তমানে দখল করেছে ইসরাইল। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে এসে দামেস্কের উপকণ্ঠে বসবাস শুরু করে।
তরুণ বয়সে তার জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না, তবে ২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়, তখন জুলানি ইরাকে গিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন এবং মার্কিন বিরোধী প্রতিরোধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে মার্কিন বাহিনী তাকে আটক করে এবং কারাবন্দি রাখে। পরবর্তীতে তাকে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠানো হয়। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্ত হন এবং এরপর সিরিয়ার বিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে ভূমিকা
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এই অস্থিরতার সুযোগে আবু বকর আল-বাগদাদি তাকে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট গঠনের দায়িত্ব দেন। এর মাধ্যমে তিনি ব্যাপক পরিচিতি এবং ক্ষমতা অর্জন করেন। সিরিয়ার ইদলিব অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে তার নেতৃত্বে আল-নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে।
২০১৩ সালে বাগদাদির সঙ্গে মতবিরোধের পর, জুলানি আল-নুসরা ফ্রন্টকে নতুনভাবে সংগঠিত করে। ২০১৬ সালে যখন সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দুর্বল হতে থাকে, তখন তিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ফলস্বরূপ, আল-নুসরা ফ্রন্টের নাম পরিবর্তন করে তিনি জাবাহাত ফাতাহ আল-শাম রাখেন। পরে ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করেন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।
আসাদ সরকারের পতনে জুলানির ভূমিকা
সাম্প্রতিক বিদ্রোহী অভিযানে জুলানির নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্রোহীরা প্রথমে আলেপ্পো এবং হামা শহর দখল করে। এরপর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে তারা দামেস্কে প্রবেশ করে এবং আসাদ সরকারের পতন ঘটায়। এই অভিযানে জুলানির কৌশল ছিল বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা এবং তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে নিয়ে আসা। তার পরিকল্পনা এবং নেতৃত্ব বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছে এবং আসাদ বাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করেছে।
এইচটিএসের শাসনব্যবস্থা
২০১৭ সালে জুলানির নেতৃত্বে সিরিয়ার ইদলিব অঞ্চলে ‘সিরিয়ান স্যালভেশন গভর্নমেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কার্যত এইচটিএস-এর প্রশাসনিক শাখা। তবে, তাদের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে বিরোধীদের দমন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর বাধার অভিযোগ উঠেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাশার আল-আসাদের পতনের পর, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবে জুলানি এখন সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার সামরিক এবং রাজনৈতিক কৌশল সিরিয়ার নতুন যুগের ভিত গড়তে সক্ষম হবে কিনা, তা সময়ের উপর নির্ভর করবে।
জুলানির জীবন ও নেতৃত্বের কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং সামরিক কৌশল নিয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং এটি বিশ্বব্যাপী সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে।