বাংলাদেশের কথিত আয়নাঘরের মতো সিরিয়ায় মিলল 'মানব কসাইখানা'

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম

ছবি : নেত্র নিউজ।
সিরিয়ার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশটিতে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। তবে তার পতনের পর উন্মোচিত হয়েছে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়, যেখানে কারাগারগুলোতে বন্দীদের ওপর চালানো হয়েছিল অমানবিক নির্যাতন। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা এসব নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম ছিল সায়দনায়া কারাগারের 'মানব কসাইখানা', যেখানে বন্দীদের অমানুষিক যন্ত্রণা দেয়া হতো।দামেস্কের কুখ্যাত মেজ্জেহ কারাগার। ছবি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সৌজন্যে
বন্দী নির্যাতনের চিত্র ও কারাগারগুলো থেকে মুক্তির ঘটনা
বাশারের পতনের পর বিদ্রোহীরা বিভিন্ন কারাগারে অভিযান চালিয়ে বন্দীদের মুক্তি দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, বন্দীরা আনন্দে চিৎকার করছে এবং নারীরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি ছোট শিশু কারাগার থেকে বের হচ্ছে, পাশে থাকা নারীরা আবেগে আপ্লুত।
সায়দনায়া কারাগারে বিদ্রোহীরা লুকানো ভূগর্ভস্থ সেলের সন্ধান পায় এবং উদ্ধার অভিযানে হোয়াইট হেলমেটস নামে পরিচিত উদ্ধারকারী সংস্থা পাঁচটি বিশেষজ্ঞ দল মোতায়েন করে। অনুসন্ধান ও উদ্ধার ইউনিট, প্রাচীর ভাঙার বিশেষজ্ঞ, লোহার দরজা খোলার টিম, প্রশিক্ষিত কুকুর ইউনিট এবং মেডিকেল টিমসহ এই সংস্থা উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে। যদিও এখনো কোনো লুকানো সেল শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।ছবি: গেটি ইমেজ।
সিরিয়ার কারাগারগুলোর নির্মম বাস্তবতা
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত সায়দনায়া এবং পালমিরার মরুভূমিতে তাদমর কারাগার ছিল দেশটির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারাগার। ২০১৪ সালে সিরিয়ার এক সরকারি কর্মচারী ‘সিজার’ ৫৩ হাজার ২৭৬টি নথি প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায়, ৬ হাজার ৭৮৬ জন বন্দী সরকারি হেফাজতে মারা গেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সালে সায়দনায়া কারাগারকে 'মানব কসাইখানা' বলে আখ্যা দেয়। তারা জানায়, হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বা নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বন্দীদের খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।
ন্দীদের ওপর নির্যাতনের পদ্ধতি
সিরিয়ার কারাগারগুলোতে বন্দীদের চাবুক দিয়ে পেটানো, ঘুমাতে না দেওয়া, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা এবং ধর্ষণের মতো অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো। পুরুষ ও নারী উভয়ের ওপরই এই নির্যাতন চালানো হয়। বিশেষত তিনটি পদ্ধতি ছিল কুখ্যাত—
জার্মান চেয়ার : একটি বিশেষ ধরনের চেয়ারে বন্দীদের বসিয়ে এমনভাবে বাঁকানো হতো যে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে যেত।
উড়ন্ত কার্পেট : কাঠের পাটাতনের ওপর শরীরের অংশ বেঁধে এমনভাবে টানা হতো যে অসহ্য যন্ত্রণা হতো।
মই পদ্ধতি : বন্দীদের মইয়ে বেঁধে ধাক্কা দিয়ে পেছনে ফেলে দেওয়া হতো, এতে মেরুদণ্ড ভেঙে যেত।আসাদের কারাগারে যেভাবে ‘ফ্লাইং কার্পেট’ পদ্ধতিতে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চলত। ছবি: আল-জাজিরা
জাতিসংঘ ও বিদ্রোহীদের ভূমিকা
জাতিসংঘের সিরিয়া কমিশনের সমন্বয়ক লিনিয়া আর্ভিডসন জানান, বন্দীশালার চিত্র ভয়াবহ হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। ২০১১ সাল থেকে জাতিসংঘ সাবেক বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করে। সাবেক বন্দীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বর্ণনার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল পাওয়া গেছে। তবে এবারই প্রথম তারা বন্দীশালাগুলোর ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে।
বিদ্রোহীরা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে এবং তথ্য প্রদানকারীদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে।
কারাগারে বন্দীদের বর্তমান অবস্থা
বিদ্রোহীদের মতে, বাশারের কারাগারে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার বন্দী ছিল। অনেককে মুক্ত করা সম্ভব হলেও এখনো অসংখ্য মানুষ গোপন কারাগারে আটকে আছে। সাবেক সৈন্য ও কারাগার রক্ষীদের কাছ থেকে গোপন দরজার পাসওয়ার্ড নিয়ে বন্দীদের মুক্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, অনেক বন্দী বৈদ্যুতিক দরজার পেছনে আটকে আছেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে।
হোয়াইট হেলমেটস বন্দী মুক্তিতে সহায়তার জন্য আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছে। মুক্ত বন্দীদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী এবং বৃদ্ধরা, যারা জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন।
স্বৈরশাসনের অবসান এবং মানবাধিকারের সংগ্রাম
বাশার আল-আসাদের স্বৈরশাসনের অবসান মানবাধিকারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে তার শাসনামলের নির্মম নির্যাতনের চিত্র মানব সভ্যতার জন্য একটি গভীর কলঙ্ক। বিদ্রোহীদের প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সিরিয়ার কারাগারগুলোর এই ভয়াবহ অধ্যায়ের সমাপ্তি মানবতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।