দুর্ভোগের অপর নাম এনআইডি সংশোধন

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৩২ এএম

প্রতীকি ছবি
জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনের অপর নাম পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তি। প্রতিদিন শত শত গ্রাহক প্রধান কার্যালয়সহ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা অফিসে এনআইডির নানা ধরনের ভুল সংশোধনের জন্য আবেদন করেই চলেছেন। কিন্তু সংশোধন হচ্ছে তার ১০ শতাংশের নিচে। বাকি ৯০ শতাংশ গ্রাহক দিনের পর দিন ঘুরছেন কিন্তু সুরাহা পাচ্ছেন না। এমনকি চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সুদূর গ্রামাঞ্চলের মানুষ ছুটে আসছেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে, ঘুরছেন দিনের পর দিন।
কারো কারো এনআইডি সংশোধন হলেও অধিকাংশ গ্রাহকের এনআইডি সংশোধন না হওয়ায় তারা পড়েছেন মহাবিপদে। কারো নামের বানানে ভুল, বাবা-মা, স্বামীর নামের বানান ভুল, জন্ম তারিখ ভুল, ঠিকানায় ভুল- এসব ঘটনা অসংখ্য এনআইডিতে। এ কারণে কেউ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না, কেউ করোনা টিকা নিতে পারছেন না, আবার কারো বিদেশ যাওয়ার টিকেট থাকলে এনআইডিতে সামান্য ভুলের কারণে ভিসা হচ্ছে না, এমনি নানান ধরনের সমস্যায় ভুগছেন দেশের হাজারো গ্রাহক।
তারা এনআইডির এসব ভুলের জন্য অপেশাদার কর্মচারী বা ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের দায়ী করছেন, তাদের অপেশাদার মনোভাবকে দায়ী করেছেন। অনেকে আবার ইসির কিছু অসাধু কর্মচারীকে খুশি করে কোনো রকমে তার এনআইডির ভুল সংশোধন করতে সমর্থ হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন। এনআইডিতে ভুলের সমস্যায় শুরু থেকেই (২০০৮ সাল) ভুগছেন নাগরিকরা। এদিকে সময়মতো সংশোধন না হওয়ায় সংশোধনের জন্য আবেদনের স্তূপ জমেছে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (আইইটি ভবনের) প্রতিটি উপজেলা-জেলাভিত্তিক কর্মকর্তার টেবিলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও গ্রাহকরা এসব ছোটখাটো ত্রুটি সংশোধন করাতে পারছেন না।
কেউ আসছেন বাংলাবান্ধা থেকে, কেউ আসছেন সুদূর দক্ষিণের সুন্দরবনঘেঁষা কোনো উপজেলা থেকে। কিন্তু ইসির কর্মকর্তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দিনের পর দিন ঘুরপাক খাচ্ছেন আবেদনকারীরা। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এমনকি ছোটখাটো কর্মী বা গার্ডের দুর্ব্যবহারে অনেক সময় অফিসারের টেবিল পর্যন্ত যাওয়াও দুষ্কর হয়ে ওঠে। জাতীয় পরিচয়পত্রের এসব ছোটখাটো ভুল সংশোধনের জন্য অনৈতিকভাবে অর্থ লেনদেনে তারা বাধ্য হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় তাদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় চাকরি হচ্ছে না, কেউ বেতন পাচ্ছেন না, কেউবা ব্যাংকের নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে টাকা তুলতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না। এ রকম অসংখ্য সমস্যায় সম্মুখীন সাধারণ মানুষ।
সাতক্ষীরার সুমন মোস্তাফার জন্ম ১৯৯৮ সালে। এসএসসি সার্টিফিকেট রয়েছে। কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুলক্রমে তা দেখানো হয় ১৯৯৬ সাল। এই সংশোধনীর জন্য নিজ উপজেলায় আবেদন জমা দিয়েছেন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। সংশোধনীর জন্য দলিল হিসেবে দিয়েছেন এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট, জন্ম সনদ, বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ ও চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র। আবেদন জমা দেয়ার সময় কার্ড দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেয়া হয় ওই সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে। কিন্তু আবেদন জমা দেয়ার ৩ বছরের বেশি সময় পার হলেও তার আবেদনের অবস্থা কী এখনো তিনি জানেন না। বিগত ২-৩ বছরে অন্তত ২০-২৫ বার উপজেলা অফিসে এবং ৮-১০ বার আগারগাঁওয়ে ইসির এনআইডি উইংয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে ঘুরেও কারো কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।
বিশেষ প্রয়োজন বিধায় করোনা মহামারি উপেক্ষা করে সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের অফিসে এসেছেন আজমল হক। নাম ও বাবার নামের সংশোধনীর জন্য দুদিন ঘুরেও কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলেনি তার। বাংলাবান্ধার নমিতা সরকার স্বামী মারা যাওয়ার পর পুনরায় বিয়ে করেছেন। কিন্তু এনআইডি কার্ডে মৃত স্বামীর নাম থাকায় নানা সমস্যা। শ্বশুর বাড়িতেও অশান্তি। আবেদন করার দুবছরেও তা সমাধান হয়নি। আসছেন আর ফিরে যাচ্ছেন। এ রকম হাজারো গ্রাহক নানা ধরনের সংশোধনের আবেদন করেও দীর্ঘদিন সংশোধন না হওয়ায় এমন ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক হুমায়ূন কবীর বলেন, প্রতিদিন বহু ফাইল সংশোধনের জন্য দেশের বিভিন্ন উপজেলা-জেলা অফিসে জমা পড়েছে। তা প্রধান কার্যালয়ে আসে। অধিকাংশের ত্রুটিগুলো বয়স বা নাম সংশোধনভিত্তিক। তার স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় তাদের এনআইডি সংশোধন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন মতলবে অনেকে দ্বৈত ভোটার বা নাম-বয়স পাল্টে মামলা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এনআইডি করছে। এগুলো ঠেকাতে আমরা সতর্কভাবে চলছি। তবে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেলে সেটি সংশোধনযোগ্য বলে জানান তিনি। তবে অর্থ লেনদেনের কোনো ঘটনা তার জানা নেই। এমনটি প্রমাণ হলে ওই কর্মীকে শাস্তির আওতায় নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে ইসির দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে প্রতিদিন হাজার খানেক আবেদন জমা পড়ে। এ বিষয়ে তিনটি ক্যাটাগরি রয়েছে। যার মধ্যে সামান্য ভুল থাকলে তা উপজেলা-জেলা অফিস থেকে সমাধান করা হয়। কিন্তু নানা ছুতোয় উপজেলা বা জেলা কার্যালয় এনআইডি সংশোধনে নানান বাহানা দেখায়। এ কাগজ সে কাগজ চায়, যার ফলে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে লক্ষাধিক এনআইডি সংশোধনের জন্য পড়ে রয়েছে। আর বয়স বা জটিল কোনো সংশোধনের জন্য আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে চলে আসে। অর্থাৎ বি এবং সি ক্যাটাগরির আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে পাঠান তারা। বর্তমান বি ক্যাটাগরির প্রায় ১০ হাজার আবেদন এবং সি ক্যাটাগরির হাজারের ঊর্ধ্বে আবেদন ইসিতে জমা আছে। এসব আবেদনের স্বপক্ষে তেমন কোনো কাগজপত্র বা প্রমাণপত্র জমা দিতে না পারায় আবেদনগুলোর সুরাহা করা যাচ্ছে না বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।
তবে আবেদনকারীরা বলেছেন, তাদের আবেদন কোন টেবিলে আছে তা না জানা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে যেতে না পারা বা না যেতে দেয়া, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে না পারায় তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারছেন না। যার ফলে বছরের পর বছর ঘুরেও অতি প্রয়োজনীয় এনআইডি সংশোধন করতে পারছেন না, যার জন্য ইসিকেই দায়ী করেছেন ভুক্তভোগীরা।