যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি ডেনিমের আধিপত্য

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:২৩ পিএম

ফাইল ছবি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ডেনিম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান আরো জোরদার করেছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক আমদানি কমালেও দেশটিতে ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ডেনিম পণ্য রপ্তানি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের টেক্সটাইল এন্ড অ্যাপারেল অফিস (ওটেক্সা) অনুসারে আগের বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি ৪৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। গত দুই বছরে, বাংলাদেশ ডেনিম রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছে। কারণ বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক ইতোমধ্যেই বিশ্ব সেরা হিসাবে গণ্য হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের কারণে স্বল্পসময়ে উৎপাদন এবং কম দামে পোশাক কিনে মুনাফা তৈরির সুযোগ থাকায় বাংলাদেশ ডেনিম পোশাকের আকর্ষণীয় উৎসে পরিণত হয়েছে। গুণগত মানের কারণে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’কে ক্রেতারা এখন উচ্চ মানের একটি অভিজাত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই ডেনিম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভাইস- প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, মার্কিন ক্রেতারা এখনো বাংলাদেশে আসছে- কারণ, এখানে তারা কম দামে ডেনিম গার্মেন্টস কিনতে পারে। এ কারণেই বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি খাতে আধিপত্য ধরে রাখতে পারছে। স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো কাপড় সরবরাহ করায় বাংলাদেশে ডেনিমের তৈরি পোশাক প্রস্তুত করতেও সময় কম লাগে।
ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম আট মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিন্সের মোট আমদানি ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সোর্সিং জার্নালের প্রতিবেদন অনুসারে, পোশাক বিক্রি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ বা ৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন থেকে ৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম লেভিস। এর আগে বিক্রি ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন পর্যন্ত বাড়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তবে ইউরোপে ডেনিম রপ্তানির বাজারের অবস্থা এখনো খুব একটা ভালো নয়। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে ভোক্তাদের পোশাক চাহিদা কমছে।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টর মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, যুদ্ধের কারণে ইউরোপের ডেনিম বাজার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ক্রেতা শিপমেন্ট পেছানোর অনুরোধ করছেন। আবার নতুন অর্ডারগুলোও দেরিতে আসছে বলে জানান তিনি। রুবেল আরো বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানি কমেছে। অনেক ক্রেতা তাদের পেমেন্ট দেরিতে পরিশোধ করছেন ফলে রপ্তানিকারকদের ওপরেও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
উন্নত প্রযুক্তিতে ভর করে এগিয়ে যেতে চায় ডেনিম : উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদনের মাধ্যমে গুণগত মানের পাশাপাশি পণ্যের মূলমান বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশের ডেনিম ও পোশাক প্রস্তুতকারীরা। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে গতানুগতিকের তুলনায় উৎপাদন খরচও প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা। এমনকি কিছুক্ষেত্রে বাংলাদেশই হবে অত্যাধুনিক এসব প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহারকারী। নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে পানি ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কমিয়ে আরো পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য ওয়াশ করা সম্ভব হবে। অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বের প্রথম এলইইডি প্ল্যাটিনাম সার্টিফাইড ডেনিম উৎপাদনকারী এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড প্রথম থেকে টেকসই পরিবেশবান্ধব টেক্সটাইল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান জিনোলজিয়া এসএলের সঙ্গে একটি অত্যাধুনিক ইকো-ল্যাব স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রতিষ্ঠানের মতে, পরিবেশবান্ধব ল্যাব স্থাপন করতে প্রাথমিকভাবে ১২ মাসের জন্য দুই লাখ ৭০ হাজার ইউরো খরচ হবে- যা নিয়মিত হালনাগাদ করার প্রয়োজন পড়বে।
প্যাসিফিক জিনসের হাত ধরে শুরু হয় কোয়ালিটি ডেনিম রপ্তানি : চট্টগ্রাম ইপিজেডের শিল্প প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনসের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত নাসির উদ্দীনের হাত করে বাংলাদেশে কোয়ালিটি ডেনিম রপ্তানির যাত্রা শুরু। ১৯৮৪ সালে এনজেডএন ফ্যাশনওয়্যার নামে ছোট একটি কারখানায় ডেনিম উৎপাদন শুরু হলেও তখন দেশে কোনো ওয়াশিং প্ল্যান্ট ছিল না। লন্ড্রির কাজগুলো ইতালিতে করতে হতো। এক বছর পর তারা ইতালির ক্রেতার সহযোগিতায় দেশে ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে।
স্থানীয় খাতে বিনিয়োগ : রপ্তানি বাজারে ডেনিম কাপড়ের চাহিদা বিবেচনায় টেক্সটাইল খাতের দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ১৯৯৮ সালে সুইস-জার্মান প্রতিষ্ঠান বেনিনজারের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডেনিমের জন্য বিশেষায়িত কারখানা সাশা ডেনিম স্থাপন করেন।
প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরুর আগে আরো দুটি ডেনিম প্রস্তুতকারক বেঙ্গল ইনডিগো ও বেক্সিমকো ডেনিম উৎপাদন করলেও তা ছিল স্থানীয় বাজারের জন্য। ২০০৮ সালে এনভয় টেক্সটাইলস বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে রোপ ডাইড প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের কারণে বাংলাদেশের ডেনিম জিনস আন্তর্জাতিক বাজারের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ঢিমেতালে চললেও ডেনিম জিনস প্রবৃদ্ধি রক্ষা করতে সক্ষম বলে জানিয়েছে কারখানা সংশ্লিষ্টরা। যেহেতু এত আকর্ষণীয় মূল্যে ও কম সময়ে অন্য কোথাও থেকে ডেনিম পাওয়া সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো ভালো হলে ক্রেতারা বাংলাদেশে আরো ক্রয়াদেশ নিয়ে আসবে।
ডেনিম ও জিন্সের পার্থক্য : এক টুকরো ডেনিম কিন্তু জিন্স নয়, তবে সব জিন্সই ডেনিম। ডেনিম হচ্ছে ফেব্রিক। ডেনিম ফেব্রিক ১০০% কটন টুইল বা স্টেচ টুইল দিয়ে তৈরি হয়। এ ফেব্রিক দিয়ে তৈরি হয় শার্ট, জিন্স, ব্যাগ, জ্যাকেটসহ আরো অনেক কিছু।
অপরদিকে জিন্স হচ্ছে এক ধরনের পোশাক। আরামদায়ক ও সহজে ময়লা হয় না বলে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এই পোশাক। মূলত জিন্স বলতে ডেনিম ফেব্রিক দ্বারা তৈরি প্যান্টকে বোঝানো হয়। ডেনিম দিয়ে অনেক গার্মেন্টস তৈরি করা যায়, কিন্তু যে প্যান্ট তৈরি হবে সেটাই জিন্স। নীল রং যদিও জিন্সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তবে এখন নানা রংয়ের জিন্সের দেখা মেলে বাজারে।