পুলিশের ভয়ে ঘরছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীরা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৬ এএম

ফাইল ছবি
২০৬টি মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে ১১ বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম নয়ন। পুলিশি নির্যাতন আর গ্রেপ্তার আতঙ্কে ২০১১ সালের পর গ্রামের বাড়ি মাগুরায় যাওয়া হয়নি তার। যুবদলের এই নেতা ভোরের কাগজকে জানান, পুলিশ মাঝে মধ্যে বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে হুমকি-ধামকি দেয়। দু’দফা মারধরও করেছে বাবাকে। ২০১৪ সালে পুলিশ হত্যাসহ ৫৩ মামলায় ৭৭ দিন রিমান্ডে নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। এ সময় হাত ও পায়ের সব নখ তুলে ফেলা হয়, মাথায় বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। এছাড়া সে সময় এমন নির্যাতন করা হয়েছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জেল খেটে বের হয়ে এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নয়ন। সভা-সমাবেশে যান খুব সতর্কভাবে। ওখানেও পুলিশ খোঁজে। সাম্প্রতি এলাকায় পুরনো মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির স্থানে তার নাম ঢোকানো হয়েছে। তবে এখন আর ভয় পান না- বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নয়ন। কেবল নয়নই নয়- বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী এখন পুলিশি নির্যাতন আর নতুন মামলা আতঙ্কে নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজপথে সক্রিয় বিএনপি। তাদের আন্দোলন প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীনদের উচ্চপর্যায় থেকে স্থানীয় নেতাকর্মী ও পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি তালিকা করা হচ্ছে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের। একাদশ নির্বাচনের আগে তৈরি করা পুরনো তালিকার সঙ্গে আরো নাম যোগ করে নতুন তালিকা করা হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশব্যাপী বিএনপির নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের তালিকায় থাকছে- প্রতিটি থানা ও পাড়া-মহল্লাভিত্তিক নেতাকর্মীর নাম-ঠিকানা, বিভিন্ন কমিটিতে পদ ও মুঠোফোন নম্বর।
বিএনপির অভিযোগ- জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচি ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দল নতুন ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের নামে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অনেক এলাকায় মামলার আগেই নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপিকে জড়ানোর কৌশল হিসেবে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। যাদের নামে মামলা নেই, তাদেরও এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। তৃণমূলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের তালিকা করে তাদের বাসায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন। তবে বিএনপির এসব অভিযোগ নাকচ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা মামলা থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতেই পারে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকর্মীরা এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছেন। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের বাসায় তারা গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন। এসব নেতাদের নিরাপদে থাকার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
সূত্র জানায়, পুলিশি নির্যাতনের শিকার এসব নেতাদের নিরাপদে রাখতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ৫ম তলায় নতুন ৪টি কক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ জন নেতা ওইসব কক্ষে রাত্রিযাপন করেন। দিনের বেলায় তারা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন। তবে নতুন তৈরি করা এসব কক্ষগুলোতে কোনো নেতাকর্মীর থাকার অনুমতি নেই বলে জানিয়েছেন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
বিএনপি সিনিয়র নেতাদের দাবি, এক যুগের বেশি সময়ে দলের ৮শ নেতাকর্মীকে গুম-খুন করা হয়েছে। ৩৫ লাখ নেতাকর্মীকে মামলার আসামি করা হয়েছে। নতুন করে ৩০ হাজার নেতাকর্মী গায়েবি মামলার আসামি হয়েছেন। মামলার এজাহারে দেখা গেছে, আসামি হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই বিএনপির পদধারী সক্রিয় নেতাকর্মী। এরমধ্যে অনেকেই অসুস্থ, বয়সের কারণে চলাফেরা করতে পারেন না, কেউ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে আছেন, ব্যবসায়িক কাজে অন্যত্র ছিলেন এমন ব্যক্তিও আছেন আসামির তালিকায়।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পুলিশ বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার নামে যে হয়রানি করছে তা কেবলমাত্র ভয় দেখিয়ে চলমান আন্দোলন দমিয়ে রাখতে। পুলিশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৪৩ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ আইনবিধি কিংবা অন্য কোনো আইনেও সমর্থনযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, হামলা-মামলা, নির্যাতন করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার মিশনে সরকার সফল হবে না। বিএনপি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি ঐক্যবদ্ধ। দেশের এ দুর্দিনে দলের নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমে আসছেন। দিন যত যাচ্ছে সভা-সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়ছেই। সাধারণ মানুষও এতে অংশ নিচ্ছে। একটি কার্যকর গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে বিদায় করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে। এর বিকল্প আমরা কিছু ভাবছি না।
সরকার ‘গোপন তৎপরতা’ চালাচ্ছে অভিযোগ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ঠিকানাসহ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে পুলিশ। একটা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমার প্রশ্ন হলো- এই নাম-ঠিকানা দিয়ে তারা কী করবে? যদি এদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়, সারাদেশের মানুষকে নিয়ে আমরা রাজপথে নামব।
ঘোড়াশাল পৌর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন চিশতিয়া বলেন, ৩০টি মামলা নিয়ে ১১ বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও এখন জায়গা দেয় না। এক জায়গায় ২ দিনের বেশি থাকতে পারি না। আপতত বিক্রমপুর নানির বাড়িতে আছি। এলাকায় কোনো দলীয় কর্মসূচি থাকলে যাই, শেষ হলেই আবার চলে আসি। বৌ-বাচ্চা ঢাকায় এসে দেখা করে। এখন আবার নতুন করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ যে তালিকা করছে, সেই তালিকায় ১ নম্বর আসামি আমি। জানি না কপালে কী আছে। তবে রাজপথে আছি, থাকবো।
ডিএমপি সূত্র জানায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের থানা, ওয়ার্ড ও মহানগর পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির সদস্য এবং পাড়া-মহল্লা পর্যায় পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা করা হচ্ছে। বড় দল হিসেবে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আগাম তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান বলেন, পুলিশের যে ইউনিট দেশব্যাপী বিএনপির নেতাকর্মীদের তালিকা চেয়েছে, এটি তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। কেবল বিএনপির নেতাকর্মী নয়, অন্য সংগঠনগুলোর তালিকা হালনাগাদ করার জন্যও এটি করা হচ্ছে।
দুঃসময়ে কর্মীদের পাশে নেতারা
মামলা-হামলায় কোণঠাসা না হয়ে বিএনপিতে বাড়ছে ঐক্য। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সৌহার্দ ও সহানুভূতি। হামলায় আহত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। শুধু আহত নেতাকর্মী নয়, নিহত কর্মীদের পরিবারের দিকেও বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহযোগিতার হাত। দিচ্ছেন আজীবন দায়িত্ব নেয়ার আশ্বাস। সম্প্রতি দলীয় কর্মসূচি চলাকালে তৃণমূলে ৪ জন নেতা মারা গেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবার পরিবারের কাছে ছুটে গিয়ে যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বিগত হামলায় যেসব নেতাকর্মী আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজখবর রাখছে কেন্দ্র। যাদের নামে মামলা হচ্ছে তাদের আগাম জামিনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। দলের এমন কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, হামলা-মামলায় ভীত না হয়ে নেতাকর্মীরা আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। সরকার হটানোর আন্দোলনে দিন দিন তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। কোনো বাধাই এবারের আন্দোলনকে দমাতে পারবে না। তিনি বলেন, নেতাকর্মীদের যে কোনো বিপদে অতীতের মতো আগামীতেও দল তাদের পাশে থাকবে। এতে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবে। দল তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ভেবে একটা ভরসা পাবে।