কারাগারে বসে নতুন জঙ্গি সংগঠনের ছক

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ০৩:০০ পিএম

গ্রেপ্তারকৃতরা। ছবি: ভোরের কাগজ

নেতৃত্বদানকারী শামিন

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার গঠনের পরিকল্পনা হয় কারাগারে। বিগত ২০১৭ সাল থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটি গঠনের কাজ শুর করে দেয় সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণও শুরু হয় সংগঠনটির। সম্প্রতি সংগঠনটির বেশ কয়েক জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য কি তা এখনো জানে না। তবে, সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শামিন মাহফুজ। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো.আসাদুজ্জামান।
মো.আসাদুজ্জামান বলেন, বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সিটি ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন নাটোরের মো.আব্দুল্লাহ (২২), কুমিল্লার চান্দিনা মো.তাজুল ইসলাম (৩৩), নারায়ণগঞ্জ মো.জিয়াউদ্দিন (৩৭), মাদারিপুর মো.হাবিবুল্লাহ (১৯) ও নারায়ণগঞ্জ মো মাহামুদুল হাসান (১৮)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৩ টি ফোন, ফতওয়া সংক্রান্ত ১২ পাতা কাগজ জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ আনসার হাউস পরিচালনা করতো। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন জঙ্গী সংগঠনের যেসব সদস্য হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেত তাদের এই আনসার হাউজে জায়গা দিত আব্দুল্লাহ। পরে সেই আনসার হাউস থেকে আব্দুল্লাহ এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে পাঠাতো।
এছাড়া গ্রেপ্তার তাজুল ও হাবিবুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্যরা আনসার হাউজে আসতেন তাদেরকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসতেন।
তিনি বলেন, বিগত আগস্ট মাসে কুমিল্লা থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক যোগে সাত তরুণ ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় হিজরতের উদ্দেশ্য। এ বিষয়টি দেশ ব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরে এ বিষয়ে সিটিটিসি তদন্ত শুরু করে। তদন্তর এক পর্যায়ে এর আগে আবরার নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করি। আবরারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসা বাদে জানা যায়, হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিল। ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী নামে এক জঙ্গি আবরারকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল। এরপর ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালীকেও আমরা গ্রেপ্তার করি। এই শাকের বিন ওয়ালি হচ্ছে এ নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। শাকের বিন ওয়ালী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পড়াশোনা করেছে। শাকের বিন ওয়ালী জঙ্গি সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও সে আরেক হুজুরের নির্দেশে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা কাজ করতো।
এই শাকের বিন ওয়ালি প্রতি মাসে একবার করে পার্বত্য বান্দরবান এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। সেখানে তাদের কোন সদস্য অসুস্থ বা কোন রোগে আক্রান্ত হলে তিনি চিকিৎসা দিতেন। মূলত নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অসুস্থ সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্যই প্রতি মাসে তিনি একবার করে প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। আবার তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন তখন তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনটি প্রধান শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। ফোনে সদস্যদের অসুস্থতার লক্ষণ শোনে ব্যবস্থাপত্র পাঠাতেন শাকের বিন ওয়ালী। এছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সাথে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকিচিনের সদস্যরা আহত হলে সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করতেন ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী।
তিনি আরও বলেন, ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালীকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা একজন লোকের নাম পাই। তিনি দেশের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেছেন এবং একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরিও করতেন। তার নাম হচ্ছে মহসিন এলায়েস ওরফে রিয়েল। সে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী গত দুই দিন আগে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে৷ নতুন সংগঠনটির সৃষ্টির বিষয়ে ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, নতুন সংগঠনটির প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। বিগত ২০২১ সালের পূর্ব পর্যন্ত রক্সি ছিল এই সংগঠনের আমির। বিগত ২০২১ সালে রক্সিকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। গত দুয়েক দিন আগে আমরা রক্সিকে আবার রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। রক্সি আমাদের জানায়, এই সংগঠনের মূল মাস্টার মাইন্ড শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার। বিগত ২০১৪ সালে শামিন মাহফুজ ওরফে স্যারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর আগে রক্সিও ২০১৫ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। রক্সি ও শামিন যখন এক সঙ্গে জেলখানায় ছিলো তখন তারা সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসে। আবু সাইদের সংস্পর্শে এসে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে। এই তিন জন জেলখানায় বসে নতুন সংগঠনটি তৈরি করার পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা হয় রক্সি ও শামিন জেলখানা থেকে বের হয়ে জেল থেকে বের হওয়া জঙ্গি ও বাহিরে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে শক্তিশালী একটি জঙ্গি সংগঠন গঠন করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জামিনে বের হয়ে রক্সি ও শামিন কাজ শুরু করে।
এই ধারাবাহিকতায় তারা সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ি এলাকায় একটি ক্যাম্পের সন্ধান শুরু করে।
[caption id="attachment_378580" align="aligncenter" width="700"]
সিটিটিসি প্রধান বলেন, ডাক্তার শাকের, কৃষিবিদ মহসিন ও রক্সি জানায়, শামিন মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে পাহাড়ি এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করারা জন্য পরিকল্পনা করে আসছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালে যখন সে জামিনে বের হয়ে আসে তখন সে পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকে। সে জানতে পারে পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনটির প্রধান হলেন নাথাং বোম। এই নাথাগ বোম হচ্ছে শামিন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্টতম বন্ধু। শামিন মাহফুজ ও নাথাং বোম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এছাড়া শামিন একটি ক্যাডেটে কলেজের মেধাধী ছাত্র ছিলেন। সে মেধাবী তালিকায় স্থান করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পাস করে। সেই নাথাং বোমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শামিন তাকে তার সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাব দেন। নাথাং বোম শামিনকে জানায় তারা অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিবে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে হিসেবে ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে মিলিত হয়। এই মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন শামিন, রক্সি, মসীন এবং বিকাশ ও তমাল নামে আরেক জন। কুচিনের পক্ষ থেকে মিটিং এ ছিলেন নাথাং বম ও তার দুই সহযোগী। মিটিং অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হলে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবিরে কাটআউট পদ্ধতিতে যাওয়া শুরু কর। এছাড়া ডাক্তার শাকের বিভিন্ন সময় এই প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন।
আমরা প্রাথমিকভাবে যতটুক জানতে পেরেছি তারা পার্বত্য অঞ্চলকে প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে যেন তাদের সদস্যদের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা বজায় থাকে। প্রাথমিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য যেটা বুঝা যাচ্ছে সেটা হচ্ছে তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্লেন ল্যান্ডে এসে হামলা করে যেন নিরাপদে আবার পার্বত্য অঞ্চলের ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারে।
তিনি বলেন, তবে সংগঠনটির অর্থের অনুদান কোথায় থেকে আসে এবং তাদের এই নেটওয়ার্কের বাইরে অন্য কোন নেটওয়ার্ক আছে কিনা বা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাটি কি ছিল তা আমরা সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ড শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করতে পারলে জানতে পারব। তবে তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশব্যাপী জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল তা আমরা কিছুটা হলেও ধ্বংস করতে পেরেছি।
এই সংগঠনের কত জন সদস্য হিজরতের নামে নিখোঁজ রয়েছে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমাদের কাছে থাকা তথ্য মতে এখন পর্যন্ত ৭০ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। হয়তো সবাই প্রশিক্ষণে যায়নি। আমরা যতটুকু জানি তিন ধাপে প্রশিক্ষণ শিবির লোক পাঠানো হয়েছে। তবে সবাই সেখানে যায়নি, অনেকে কোনো সেল্টার হোমে থাকতে পারে। অথবা আগের হিজরতের অনুযায়ী ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে আছে।
সংগঠনটির উদ্দেশ্য কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজ গ্রেপ্তার করলে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। তবে তারা দেশে ভিতরে নাশকতা তৈরি একটা উদ্দেশ্য ছিল। তবে এর বাহিরে কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা তা শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করতে পারলে জানা যাবে।
নির্বাচন কেন্দ্রিক নতুন জঙ্গি সংগঠনের কোন পরিকল্পনা ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়তো তাদের এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। তবে সংগঠনের প্রধান কে গ্রেপ্তার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে তাদের নির্বাচন কেন্দ্রিক কোন পরিকল্পনা আছে কিনা। বা তারা কোন প্রেসক্রিপশন নিয়ে মাঠে নেমেছে কিনা অথবা কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে মাঠে নেমেছে কিনা।
অপর আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শামিন মাহফুজ কলেজ পড়ার সময় সে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে তাকে শিবির করার অভিযোগে ক্যাডেট কলেজ থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে নিকট আত্মীয়র সংস্পর্শে জঙ্গিবাদে জড়ায়। এছাড়া তার স্ত্রী জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গ জড়িত।