মিত্রবাহিনীর দখলে ঢাকার আকাশ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:১৭ এএম

ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে তৃতীয়বার ভেটো দিল রাশিয়া
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। চারপাশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে ফেলে মিত্রবাহিনী। দিকেদিকে ওড়ছে বাঙালির বিজয় নিশান। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। ঢাকা ছাড়া গোটা দেশই তখন বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে।
ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরায় অবস্থান নেয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স। টাঙ্গাইলে নামে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনারা। রাত ৯টায় টাঙ্গাইল পৌঁছান ভারতীয় মেজর জেনারেল গান্ধর্ব নাগরা। মুক্তি-মিত্রবাহিনী জয়দেবপুর, টঙ্গী ও সাভার হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয়। যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তী সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার ৫-৬ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়। বাসাবো ও খিলগাঁওএলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকিস্তান বাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে তখন ঢাকার আকাশ। অবস্থা বেগতিক দেখে বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখার জন্য ভারতীয় জেনারেল মানেকশ’র প্রতি আহ্বান জানায় জেনারেল নিয়াজি। আকাশ, জলে-স্থলে অবরুদ্ধ নিয়াজির রাওয়ালপিন্ডিতে আরজি, ‘আরও সাহায্য চাই।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র পঞ্চম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড থেকে জানা যায়, ডিসেম্বরের এইদিনে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। শুধু ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় মানুষের অবিরামযুদ্ধ চলে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন। প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে- ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে তৃতীয়বারের ভেটো রাশিয়ার : পাকিস্তানকে রক্ষায় মরিয়া মার্কিন-চীনের কূটনৈতিক শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো ভেটো দেয় রাশিয়া। এই দিনই বঙ্গোপসাগর দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর। এ সময় মিত্রবাহিনী জানমালের ক্ষতি কমাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দেয়। শান্তি কমিটি, গভর্নর ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা তৎকালীন গভর্নর হাউসে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বৈঠক চলাকালে মিত্রবাহিনীর বিমান গভর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ করে- গভর্নর ডা. মালিক তখনই পদত্যাগ করেন এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে রেডক্রসের গাড়িতে করে নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে আশ্রয় নেয়।
এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এডিসি স্কোয়াড্রন লিডার আরশাদ সামি খাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ইয়াহিয়া খানকে ফোন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। আরশাদ সামি ইয়াহিয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ফোনটা দেন। নিক্সন এ সময়ই ইয়াহিয়াকে সাহায্য করতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সপ্তম বহর পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন এডিসি আরশাদ।
এদিকে যুদ্ধ জয়ের নিশ্চয়তা জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশি নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে।