বার্মিজ গরু পাচারের নতুন রুট নাইক্ষ্যংছড়ি

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:২৫ পিএম

নাইক্ষ্যংছড়িতে গরু পাচারের নতুন রুট। ছবি: ভোরের কাগজ


- জনপ্রতিনিধি-নেতাদের বিরুদ্ধেও পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ
- আসছে মাদকও
- ওপার থেকে পাচারে সহায়তা করছে আরাকান আর্মি, আরসা ও আরএসও
বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলের বান্দরবানের আলীকদম ও লামা দিয়ে গরু (বার্মিজ) এনে পাচার করা হলেও পথ পাল্টেছে পাচারকারীরা। বর্তমানে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী সংলগ্ন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা থেকে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নকে পাচারের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। সরকার যেখানে বাইরে থেকে গরু আনাকে নিরুৎসাহিত করছে সেখানে প্রতিনিয়তই এসব জায়গা দিয়ে শত শত গরু প্রবেশ করছে অবাধে।
গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘গবাদি পশুতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। যতবারই তিনি ভারত সফর করেছেন, সেখানকার সরকার বলেছে তোমাদের গরু দেবো না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি বলি, আপনারা গরু দেয়া বন্ধ করে দিলেই বরং আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। আমরা গবাদিপশুতে প্রায় স্বনির্ভরশীল। আপনারা বন্ধ করলেই পুরোপুরি হয়ে যাবো। এর মধ্যেই মিয়ানমার হয়ে গরু প্রবেশ করছে।’

এদিকে, মাঝেমধ্যেই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে গরু আটক করছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে পাচারকারীরা। এর পাশাপাশি, অভিযোগ উঠেছে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত। প্রশাসনকে ম্যানেজ (ব্যবস্থা) করে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এছাড়া, গরু পাচারের সময় ইয়াবার মতো নেশাদ্রব্য এবং মাদকও প্রবেশ করছে দেশে। এর ফলে সরকার একদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে মাদক বিস্তারেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওপারে মিয়ানমারের গরু পাচারকারীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত। এ কারণে তাদের কাছে কেউ যেতে সাহস করে না। কারণ এই চোরাচালান চক্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে মিয়ানমার সরকার বিরোধী তিনটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দল। তিনটি দল হচ্ছে আরাকান আর্মি, আরসা ও আরএসও। এই তিনটি সশস্ত্র দলের দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যয়ের একটি বড় অংশই আসে এই চোরাচালান খাতে অর্জিত অর্থ থেকেই। যে কারণে প্রশাসনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী সদর ইউনিয়নের কম্বোনিয়া, জারুলিয়াছড়ি, ফুলতলী, আশারতলী, জামছড়ি, চেরারকুল, চাকঢালা, নিকুছড়ি ও বাইশারীর ঈদগড়, আলীক্ষ্যং ও কাগজীখোলাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের গরু পাচার হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, নাইক্ষাংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল আফছার ইমন, বাইশারি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো.আলম, রামু কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু নোমান গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত আছেন। এছাড়া, গিয়াসউদ্দিন, আতাউল্লাহ, জহির, আলী হোসেন, ছাহ্লা, নুরুল ইসলাম, আবদুল গফুর, নুরুল, ফকির আলম, নজরুল, কচ্ছপিয়ার জসিম, জহির উদ্দিন, আবুল কালাম, এম সেলিম, আবদুর রহিম ও লামা ফাসিয়াখালির আওয়ামী নেতা কুতুব উদ্দিন মেম্বার এ ব্যবসা করছেন। আবার অনেকে প্রশাসনকে ম্যানেজ (ব্যবস্থা) করে পাচারে সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিচ্ছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে পাচারকারীদের মধ্যে কুতুব মেম্বার, রামুর কচ্ছপিয়ার জহির ও জিয়াবুলসহ বেশ কয়েকজন তাদের নিজস্ব খামারে দেশীয় গরুর পাশাপশি মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা গরু এনে জমা রাখে। পরে তা সুযোগ বুঝে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই তারা তাদের খামার থেকে গরু পাচার করে আসছে।
এছাড়া, অনেক সময় আটক হওয়া গরুগুলো পাচারকারীরা নিজেরা মিলে সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে বাজার দরের তুলনায় অনেক কমদামে কিনে নেয়। এখানেও ভাগবাটোয়ারার বিষয় থাকে।
এ বিষয়ে বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতাকাল শনিবার তিনি ভোরের কাগজকে জানান, বাইশারী থেকে বেশ দূরের সীমানা পথ দিয়ে বার্মিজ গরুগুলো তার এলাকা ঘেষে পার হয়। এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমার উপস্থিতিতেই গত ১২ জানুয়ারি পুলিশ অভিযানে ১৯টি গরু জব্দ করে। এর আগেও গরু জব্দ করা হয়েছে। গরু পাচারের সঙ্গে তার নাম জড়িত থাকার বিষয়ে এ জনপ্রতিনিধি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিংসা পরায়ণ হয়ে এ ধরনের কাজগুলো করছে। গরু পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলে কখনোই গরু জব্দ করতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতাম না।অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিরা বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলমের মতোই একই দাবী করে জানান তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) টানটু সাহা গতকাল শনিবার ভোরের কাগজকে বলেন, সীমান্ত বিষয়টি বিজিবির নজরদারীতে থাকে। তবে এর পরেও যখনই থানা পুলিশের নজরদারিতে এমন বিষয় আসে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। গরু বা মাদক পাচারসহ অন্যন্য যে কোনো অপরাধ দমনে আমরা শূন্য সহিষ্ণু নীতিতে (জিরো টলারেন্স পলিসি) কাজ করছি বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন ১১ বিজিবির সিও লে. কর্নেল রেজাউল করিমকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।