জব্বারের বলী খেলা : লোকায়ত বাংলার ঐতিহ্য

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৯ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বলী খেলার আভিধানিক বা সমার্থক শব্দ কুস্তি খেলা হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু বলী খেলা আর কুস্তি খেলা এক নয়। আবদুল জব্বারের বলী খেলা নিছক কুস্তি খেলা নয়। আবদুল জব্বারের বলী খেলাকে কুস্তি খেলা হিসেবে ভাবতে চাইলে এর অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্ব হারিয়ে যাবে। এর পরিধিটুকু সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার বাংলাদেশের খেলাধুলা গ্রন্থে এ কারণে এটাকে কুস্তি খেলা বলেননি।
তিনি লিখেছেন, ‘জব্বারের বলী খেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতিবছরের ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়।’ অর্থাৎ বলী খেলা ঠিক কুস্তি খেলা নয়, কুস্তি খেলার মতো। কুস্তি খেলা আর ‘এক ধরনের কুস্তি খেলা’ সমার্থক নয়। কিছু ভিন্নতা আছে। এই ভিন্নতা হতে পারে এর ইতিহাস, ঐতিহ্যে কিংবা আয়োজনের বৈশিষ্ট্যে। এছাড়া এর একটা নিপাট রাজনৈতিক সত্তা বিরাজমান। আছে মহান রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল জব্বারের বলী খেলা চট্টগ্রামবাসীর আবেগ, ঐতিহ্যের শুধু অংশ মাত্র নয়, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য জব্বারের বলী খেলাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহত্তম আয়োজন হিসেবেও বিবেচনায় নিতে হবে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আবদুল জব্বারের বলী খেলা এ বছর আয়োজনের ১১৪ বছর অতিক্রম করবে। এর মধ্যে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে এবং অতিমারির কারণে দুই বছর ছাড়া আর কখনো জব্বারের বলী খেলা বন্ধ থাকেনি। প্রতি বছর ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে আবদুল জব্বারের বলী খেলার আসর বসে। চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠের আশপাশ দিয়ে চলাচলকারী মাত্রেই খেয়াল করবেন, চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতেই ওই এলাকার দেয়ালে, মেঝেতে চিহ্ন এঁকে, নাম লিখে রাখছে। এরা আর কেউ নন, এরা আবদুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলার দোকানি। বিগত শত বছর ধরে এভাবেই চলছে। আবদুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলায় এমন কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায়, যা কিনা অন্য কোনো মেলায় পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামবাসী এসব জিনিস কিনতে সারা বছর ধরে এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে। এত সব কারণে শত বছরের প্রাচীন এই মেলাটি আজ চট্টগ্রামবাসীর আবেগ এবং ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিণত হয়ে গেছে।
১৯০৯ সালে ২৫ এপ্রিল বাংলা ১২ বৈশাখ তারিখে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। পরবর্তীকালে এই বলী খেলা আবদুল জব্বারের নামে পরিচিতি লাভ করে। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি এই খেলার সূচনা করেছিলেন। সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের জন্য অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, এ কথা সচেতন মানুষ মাত্রেই জেনে আসছেন। কিন্তু সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্রীড়াও যে লড়াই-সংগ্রামের অংশ, তা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার বাঙালির বোধের মধ্যে নিয়ে আসেন। তারই প্রকাশ আমরা আবার খুঁজে পাই, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাধ্যমে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেয়েছিলেন। সে কারণে তাদের তৎপরতায় ব্রিটিশের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। সে জন্য বিকল্প পন্থা হিসেবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা এবং তাদের সমর্থকরা। মাস্টারদার নাম তখনো জনতার কাছে পরিচিত হয়নি। কিন্তু তার কুঠির তরুণদের তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তরুণ-যুবাদের আগ্রহে তিনি সাহস সংযোগ করছেন।
তরুণ-যুবাদের শুষ্ক, শঙ্কিত মনে নতুন আশা, নতুন সাহস পল্লবিত হয়ে ওঠে। তারা ক্লাবে যায়, শরীর চর্চা করে। ছেলেদের প্রতিদিনের অভ্যস্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের অন্তরালে বাড়িতে, স্কুলে, মাঠে, ক্লাবে, ভাবি ডেথ প্রোগ্রামের সোপান চাকা ক্রমশ দ্রুততর গতিতে আবর্তিত হতে আরম্ভ করে, যার পরিণতিতে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় জালালাবাদ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। লোকনাথ বল অন্যদের নিয়ে তরুণ-যুবাদের নতুনভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় সর্বত্র শরীর চর্চা কেন্দ্র গড়তে সচেষ্ট হলেন। শহরের প্রভাব গ্রামে এসে পড়ে। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক শরীর চর্চা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। লোকনাথ বল অন্যদের নিয়ে এ কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণ দেন। চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে নতুন প্রাণের সাড়া পড়ে। ছাত্রদের মুখে মুখে লোকনাথ বলের নাম।
তারা ব্যায়াম চর্চা ও ক্রীড়া কৌশলে যোগ্যতার পরিচয় দেন। লোকনাথ বল এ সময় সহজেই আড়াই মণ ওজনের লৌহখণ্ড তুলে খেলা দেখাতেন। চলন্ত মোটর গাড়ির গতিরোধ করে ফেলতেন। মোটরের পেছনে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর মোটরচালক প্রাণপথ চেষ্টা করেও গাড়িকে সামনে এড়িয়ে নিতে পারত না। বাংলার পথে-প্রান্তরে এই দুরন্ত যৌবনের দুর্দান্ত ক্রীড়া কৌশল সেদিনের বাঙালি চিত্তের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি পূর্ণ মাত্রায় লাভ করে। আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিতসারা করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার যে বার্তা ব্রিটিশ এবং বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন তা ছিল- এ বলী খেলার মাধ্যমে জাতির মানস গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনো পুরস্কারের লোভে লালায়িত হয়ে বাংলার দামাল ছেলেদের এ পথে আসার আহ্বান জানাননি।
চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী বন্দর শহর চট্টগ্রাম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলী খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, আবদুল জব্বারের বলী খেলা ধারাবাহিকতার দিক থেকে সব চেয়ে প্রাচীন একটি খেলা। চট্টগ্রামে বলী খেলার শুরুটা নিয়ে দুটি বক্তব্য এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এই প্রসঙ্গে কবি আলাদিন আলীনুর বর্ণিত বলী খেলার উদ্ভবের ইতিকথার বিবরণটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য।
তা এরূপ : ‘প্রতি বছর চৈত্রের শেষার্ধে আর বৈশাখের প্রথমার্ধে আসে মাসব্যাপী বলী খেলার মৌসুম। সঙ্গে সঙ্গে বসে আনন্দ মেলা, নয়া নয়া পণ্যের হয় আমদানি, চলে হরদম বেচাকেনা। চারদিকে শুনি শুধু বাদ্যধ্বনি আর সানাইয়ের আওয়াজ। যখন শোনা যায় যে, দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে অর্থাৎ ১৩৪৫-৪৬ সালে পরিব্রাজক ইবনে বতুতার পরিদর্শন ধন্য বরহনক থেকে আনক্যা বলীরা খেলায় যোগ দিতে আসছে, তখন দর্শকদের আগ্রহ ও উত্তেজনা বেড়ে যায়। কবি কালিদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মালব অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল দেশ মিলুয়া থেকে সর্বপ্রথম মল্লক্রীড়ার অনুসঙ্গ হিসেবে বলী খেলার উদ্ভব এবং সমগ্র চট্টগ্রামে ব্যাপ্ত হয়।’ (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা : আবদুল হক চৌধুরী)। প্রাচীন কবি আলাদিন আলী নুর বর্ণিত ইতিহাসের সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করে গবেষক আবদুল হক চৌধুরী উল্লেখিত লিখেছেন, ‘মালিয়ারা, মিলুয়া নামের গ্রামেই যদি মল্ল ক্রীড়ার জন্মস্থান হয়, তবে অপর কেউও দাবি করতে পারেন যে, বলী খেলার প্রথম উদ্ভব রাউজান থানাতেই হয়েছে। তখন তিনি সে দাবি নাচক করতে পারবেন না। যেহেতু রাউজান থানার ডাবুয়া ইউনিয়নে মেলুয়া নামে একটি গ্রাম আছে।… বির্তকে না গিয়ে চট্টগ্রামের চতুঃসীমার মধ্যেই বলী খেলার উদ্ভব মনে করা শ্রেয়।’
তবে সব কথার শেষ কথা হলো, আবদুল জব্বারের বলী খেলার কারণেই আজ বলী খেলা বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্থান লাভ করেছে। আবদুল জব্বারের বলী খেলা ব্যতিত আর কোনো ধরনের খেলায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরম্পরা এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের মহত্তম আয়োজন আছে বলে জানা নেই। সাংবাৎসরিক এই আয়োজনের মাধ্যমে এর ঐতিহাসিক পরম্পরাকে স্মরণ করা হয়। আবার লোকায়িত সংস্কৃতির বিকাশকে বিশ্লেষণ করতে গেলেও জব্বারের বলী খেলার অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্বের কথা বিবেচনা করতে হবে। বাস্তবতা হলো, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে এখন আর বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এখন খণ্ডিত ইতিহাস চর্চার আয়োজন চলছে সর্বত্র।