চামড়া নিয়ে অস্থিরতার শঙ্কা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩, ০৮:২৫ এএম

ছবি: সংগৃহীত
> কুরবানির চামড়া ঘিরে তৎপর সিন্ডিকেট > লবণের দাম বেশি > অর্ধেকে নেমেছে চামড়া খাতে ঋণ
আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে চামড়ার দাম। পাশাপাশি সরকার এ শিল্পকে বাঁচাতে কঠোর তদারকি করছে। ইতোমধ্যে কুরবানির পশুর চামড়া যথাযথভাবে ছাড়ানো, সংরক্ষণ, বর্জ্য অপসারণ ও নির্ধারিত দামে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা ও কর্মপরিকল্পনা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এ বছরও চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটবাজির আশঙ্কা করছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করায় প্রতি বছর চামড়ার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ফলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করতে হয় চামড়া। এদিকে, একদিকে খেলাপি ঝুঁকির কারণে চামড়া খাতে ঋণ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে লবণের অতিমূল্য নিয়ে সংকটে পড়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় আসন্ন কুরবানির ঈদে চামড়া কেনাবেচা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা কমপ্লায়েন্সের অভাব। এজন্য এ খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
সারা বছর সবজি বিক্রি করলেও কুরবানির এই সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে তা বিক্রি করেন খিলগাঁও কাঁচাবাজরের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যবসা করছি কিছুটা লাভের আশায়। কিন্তু সরকার প্রতি বছর দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে কখনোই ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনেন না। এবারো একই পরিস্থিতির আশঙ্কা করেন তিনি। আবদুল হাকিম বলেন, সারাদিন বসে থেকে শেষ বেলায় খুবই কম দামে চামড়া বিক্রি করে দিতে হয়। অথচ বেশি দাম দিয়ে লবণ কিনে তা সংরক্ষণ করি। তাই লাভ তেমন থাকে না।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো কুরবানির সময়ে আমাদের যে সুবিধা দিয়ে থাকে সেটা যদি আরেকটু উদারভাবে হয়- বিশেষ করে যে নিয়মিত ব্যবসা করছে তাকে অন্তত দেয়া হোক। তাহলে আমরা ভালোভাবেই চামড়া সংগ্রহ করতে পারব। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, এ বছর রপ্তানি তিনশ মিলিয়ন ডলারের বেশি হবে। আগামী বছর তা বাড়িয়ে ৭ থেকে ৮শ মিলিয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। মিজানুর রহমান বলেন, চামড়া সংগ্রহের মূল সমস্যা বকেয়া। ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়তদারদের বকেয়া বেড়েই চলছে। গত বছর এই টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন বলছে, অনেকেই টাকা বাকি রেখে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
চামড়া ব্যবসায়ীদের হিসেবে, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এসব চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশই আসে কুরবানির ঈদ ঘিরে। কুরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকার বা আড়তদারদের কাছে। তারা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। আর ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ট্যানারি ব্যবসায়ীদের মতে, করোনার কারণে টানা দুই বছর চামড়ার ব্যবসায় মন্দা ছিল। তবে গত বছর তারা ভালো করেছেন। তাদের মতে, চামড়ার দাম বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। ফলে এ বছর কুরবানির ঈদে চামড়ার ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। অবশ্য কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা এ বছরও কুরবানির চামড়ায় বিশেষ কোনো সুখবর নেই বলে মনে করছেন। তাদের দাবি, চামড়ায় ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের কেমিক্যালের (রাসায়নিক) দাম বাড়ার পাশাপাশি লবণের দামও বেড়েছে অত্যধিক। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কাঁচা চামড়ার দামে।
গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে সব কিছুর দাম বাড়লেও চামড়ার দাম কমেছে ধারাবাহিকভাবে। ২০১৩ সালে দেশে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ২০২০ সালে সেই গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয় ঢাকায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এভাবে গত সাত বছরে প্রতি বর্গফুটে দাম নির্ধারণের স্তর বিবেচনায় গরুর চামড়া ছাগলের চামড়ায় পরিণত হয়েছে। সবশেষ গত ঈদুল আজহায় কিছুটা বাড়িয়ে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ন্যায্য দাম দূরের কথা- চামড়া বিক্রির জন্য অনেক এলাকায় ক্রেতারই খোঁজ মেলেনি গত বছরও। অবশ্য এবার চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে এমন পরিস্থিতি আর দেখতে চান না পণ্যটির সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা।
কুরবানির এই সময়ে চামড়া সংরক্ষণে কাঁচামাল হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন লবণের চাহিদা থাকে। কিন্তু চলতি মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের পরও লবণের উর্ধ্বমুখী দামের কারণে চামড়া সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দেশে ৬১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হলেও বাজারে এর প্রভাব নেই। বরং উল্টো লবণের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৩শ টাকা। আর কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা। কুরবানির আগে হঠাৎ করে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এভাবে লবণের দাম বাড়লে এর প্রভাব পড়বে কাঁচা চামড়ার ওপর। তাদের মতে, কুরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লবণের বাড়তি দাম। তারা বলেন, লবণের দাম বাড়তে থাকলে চামড়ার দাম কমবে- এটাই স্বাভাবিক।
পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আফতাব খান ভোরের কাগজকে বলেন, ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কুরবানির চামড়া নষ্ট হয়। বর্তমানে গরম অনেক বেশি, এছাড়া জ্যামের কারণে চামড়া নিয়ে আসতেও অনেক সময় লাগে। তাই পোস্তা এলাকায় সবাইকে চামড়া না এনে নিজ নিজ এলাকায় লবণজাত করার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। তিনি বলেন, লবণজাত করে চামড়া সংগ্রহের জন্য পোস্তার ব্যবসায়ীরা সাভার, হেমায়েতপুর, আমিনবাজার, বেড়িবাঁধ, কেরানিগঞ্জ, জিঞ্জিরা, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, মুন্সীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করতে পারেন- সে ব্যবস্থা রয়েছে। আফতাব খান বলেন, চামড়ার দাম ৩ টাকা বাড়িয়েছে। এটা ভালো, তবে লবণের অত্যাধিক দাম বাড়ার কারণে এই লাভ সেখানে চলে যাবে এবং এবার শ্রমিকদের পারিশ্রমিকও বেশি দিতে হবে।
অর্ধেকে চামড়া খাতের ঋণ : খেলাপি ঝুঁকির কারণে চামড়া খাতে ঋণ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকগুলো। আসছে কুরবানির ঈদ ঘিরে ৪৪৩ কোটি টাকার ঋণ ২৫৯ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এবার অপেক্ষাকৃত কম হারে ঋণ পাবেন চামড়া খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা।
দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ডজনখানেক ব্যাংক ঋণ দেয়। আবার সেই লক্ষ্যের সামান্য অংশই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এ বছর কুরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছে। আর ২০২১ ও ২০২০ সালে তা ছিল যথাক্রমে ৫৮৩ কোটি ও ৬৪৪ কোটি টাকা। এখানে দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে কমছে চামড়া খাতের ঋণ। আবার বরাদ্দ করা অর্থের একেবারে ক্ষুদ্র একটা অংশ পান চামড়া ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এ বছর ১২টি ব্যাংক মিলে ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রেখেছে জনতা ব্যাংক। মোট পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ২৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৮০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৩০ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের ৫ কোটি ৩১ লাখ, বেসিক ব্যাংকের ৫ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫ কোটি, আল-আরাফাহ্? ইসলামী ব্যাংকের ৬ কোটি ৫০ লাখ, সিটি ব্যাংকের ২০ লাখ, এনসিসি ব্যাংকের ২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, কুরবানি ঈদের চামড়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয় কয়েকটি ব্যাংক। কিন্তু এটা শুভঙ্করের ফাঁকি। কেননা, বরাদ্দ করা অর্থের মাত্র ১০ শতাংশ বণ্টন হয়। সেটাও আবার যেসব ট্যানারি ব্যবসায়ীর সক্ষমতা থাকে, কেবল তাদেরই পুনরায় ঋণ দেয় ব্যাংক। যারা বকেয়া পরিশোধ করতে পারেন না, তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করে কিছু অংশ ঋণ দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা নতুন ঋণ পান না। তিনি বলেন, এ খাতে আগের যে টাকা বকেয়া আছে, সেটা ব্লকে নিয়ে নতুন করে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করা প্রয়োজন। তা না হলে এই খাতের সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।
চামড়া সংরক্ষণ-তদারকিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫ কমিটি : কুরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও তদারকিতে পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষকে প্রধান করে সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় কমিটি, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা কমিটি, সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য কমিটি ও জেলা কমিটি করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য সিনিয়র সচিবকে প্রধান করে ১৪ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের বিভাগীয় কমিটি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইআইটি অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সাঈদ আলীসহ ছয়জনকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের প্রধান শেখ রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেল গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ২৯ জন সদস্য নিয়ে জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব কমিটিকে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।