অর্জিত হয়নি বেসরকারি ঋণের লক্ষ্য

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩, ১২:০৩ পিএম

একদিকে হু হু করে বাড়ছে সরকারি খাতে ঋণ। লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে বেশি করে গচ্ছিত রাখতে হচ্ছে নিরাপত্তা সঞ্চিতি। ব্যাংক পাচ্ছে না কাক্সিক্ষত আমানত। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট। এমন পরিস্থিতিতে নিচের দিকে নামছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের কোনো মাসেই বেসরকারি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত মে মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ১০ শতাংশে নেমেছে।
তথ্য মতে- গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা পূরণ হয় না। ২০২১-২২ অর্থবছরেও বেসরকারি খাতের ঋণের প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও প্রাক্কলিত হারের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছিল অনেক কম।
সংশ্লিষ্টদের মতে, খেলাপি ঋণ বাড়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। সুদ কম দেয়ায় আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক। অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট, টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, মুদ্রা পাচার এবং আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে উৎপাদন কমেছে। ডলার সংকটে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় চলতি অর্থবছরে দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি, যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি ও ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এছাড়া সার্বিকভাবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিনিয়োগের জায়গা সংকুচিত হওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রয়োজনেও ভাটা পড়েছে। ফলে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে যা এখনো চলমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাসে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে বেসরকারি খাতে। ফলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
সাধারণভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে থাকে। তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে যায় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ব্যাপক হারে কমে গিয়ে ২০২০ সালের মে মাসের শেষে প্রবৃদ্ধি নামে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে পরের মাস জুন থেকে তা অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংকের করা প্রাক্কলনের চেয়েও কম। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর ২০২১-২০২২-এ প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও প্রাক্কলিত হারের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছিল অনেক কম।
জানা গেছে, শুধু বেসরকারি খাত নয়, সরকারও ব্যাংক থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ নিতে পারছে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণের ঋণ দিচ্ছে, যা দিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। তবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়ায় তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। সর্বশেষ গত জুনে দেশে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে।
এদিকে অর্থের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। অর্থবছরের শুরু থেকেই এই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে তেমন একটা ঋণ দিতে পারছে না। তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এক লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
মুদ্রাবাজারে সংকটের মধ্যেই সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে আরো বেশি হারে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকারের এমন অর্থায়ন নীতির কারণে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। যদিও চলতি অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ২১ থেকে ২৮ শতাংশে উন্নীত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট দাঁড়াবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এসব বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া মানে বাজারে টাকা ছাড়া, যা মুদ্রাস্ফীতি ও লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থায়ন কমে যায় বেসরকারি খাতে। ফলে কমে যেতে পারে নতুন কর্মসংস্থান। জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে, যা দাম বৃদ্ধি করবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বাজারে ছাড়লে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এ কর্মকর্তা। অর্থের প্রচলন বেড়ে গেলে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বেড়ে যায়, যার ফলে আমদানিও বাড়ে।