ভয়ংকর আগস্ট-সেপ্টেম্বর

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:৩০ এএম

ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর ব্যাপকতা > সব জেলাকে সমান গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ > আছে বৈশ্বিক শঙ্কাও
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার ও ভয়াবহতা। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ার পাশাপাশি দীর্ঘ হচ্ছে মৃতের তালিকাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম হলেও বর্তমানে প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। এ বছর অনেক আগেই ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়েছে। পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি হওয়ায় এবার ডেঙ্গুতে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আরো ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হতে পারে এডিস মশাবাহিত এই রোগ।
কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে- জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংক্রমণ চূড়ায় অবস্থান করে। এরপর কমতে থাকে। এ বছর জুন মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলছে। দেশের ৬৪টি জেলায়ই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ করে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মশকনিধন এবং ডেঙ্গুরোগী ব্যবস্থাপনায় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরেও সমান গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কারিগরি কমিটি গঠন করে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে একদিকে যেমন হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়বে, মৃত্যুর হারও বাড়তে পারে। সামগ্রিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এবার ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ ড. রমন ভেলাউধন শুক্রবার প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার পৃথিবীজুড়েই বাড়ছে। এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক হতে পারে। রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। আর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৬৮৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ১৬৭ জনের। আক্রান্তদের অধিকাংশই ঢাকা শহর এলাকায়। ঢাকায় রোগীর সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১১ হাজার ৮০০ জন।
তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে যে সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বা মৃত্যু হচ্ছে- তার প্রকৃত চিত্র এই পরিসংখ্যানে আসছে না। কারণ অনেকেই যেমন ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হচ্ছে না। আবার দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য এখানে নিয়মিত আসছে না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গুরোগীদের তথ্য আসে না স্বাস্থ্য বিভাগে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, রোগীর যে সংখ্যা সরকারের খাতায় আসে, তা মোট সংক্রমণের একটি অংশমাত্র; কারণ অনেকের মধ্যেই উপসর্গ সেভাবে স্পষ্ট হয় না। অনেকেই পরীক্ষার বাইরে থেকে যান। এ রোগে মৃত্যুর হার ১ শতাংশেরও কম বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
আগামীর দিনগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ কর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরে ডেঙ্গু ঢাকার বাইরেও ছড়িয়েছে। এগুলো ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছে। আরো বাড়বে। ডেঙ্গুকে বড় সমস্যা হিসেবে ধরতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এতদিন আমরা শুধু ঢাকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এখন আমাদের পুরো দেশ নিয়ে কাজ করার সময় হয়েছে। এজন্য ঢাকার বাইরেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কীটতাত্ত্বিকদল, ল্যাবরেটরি, মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। একই সঙ্গে জেলা হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ, রোগী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি চিকৎসকদল গড়ে তুলতে হবে। জটিল রোগী চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে রোগীকে ঢাকায় আসতে না হয়। এতে রোগীর মৃত্যু এবং ঢাকার রোগীর চাপ কমবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, একসময় ডেঙ্গুজ্বরকে মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও গত দুই বছর ধরে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর এবং এই বছরের মধ্যে ডেঙ্গুর বিস্তারে আসলে কোনো বিরতি ছিল না। বিশেষ করে শহর এলাকায় পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে। গত বছর ডেঙ্গুর ‘পিক (সর্বোচ্চ পর্যায়)’ ছিল অক্টোবর মাসে। এখন যে অবস্থা, তা উঠতির দিকে। অক্টোবরের আগেই পিকে চলে যায় কিনা, বলা যাচ্ছে না। যে পরিস্থিতি, এতে বলা যায়, এই ধারা চলবে আরো কয়েক মাস।
পরিস্থিতি উত্তরণ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, রোগী যে হারে বাড়ছে, এতে হাসপাতালের সক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। এ জন্য এই মুহূর্তে করোনার সময়ে আমরা যেমন কারিগরি কমিটি গঠন করেছিলাম; এখন ডেঙ্গুর বেলায়ও তেমন কমিটি গঠন করা দরকার। মশকনিধনে সবার সমন্বিতভাবে কাজ করাটাও জরুরি।