একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে প্রতিবন্ধী শিশুরা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৫৪ এএম

দৈনিক ভোরের কাগজের কনফারেন্স রুমে বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ‘একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী নারীর বাধাসমূহ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত বক্তারা -ভোরের কাগজ।
অনান্য শিশুদের সাথে প্রতিবন্ধীদের একীভূত শিক্ষার আওতায় আনতে সরকার ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরেও প্রতিবন্ধী বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণের কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। ফলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যারা সুযোগ পাচ্ছে তারা সম্মুখীন হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতার।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ‘একীভতূ শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী নারীর বাধাসমূহ’ শীর্ষক এক গোলটেবিলটি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও গার্লস এডভোকেসি এ্যালায়েন্সের সহায়তায় বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড এডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যন) ও দৈনিক ভোরের কাগজ এই বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকটি ভোরের কাগজ কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তুলতে শিক্ষা কারিকুলামের সংস্কার, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রতিবন্ধী অধিকার সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মত দেন সংশ্লিষ্টরা।
ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব। প্রধান অতিথি ছিলেন- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ) মো. সোহরাব হোসাইন। বিশেষ অতিথি ছিলেন- বিশিষ্ট লেখক পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম। বি-স্ক্যানের সভাপতি সাবরিনা সুলতানার সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সদস্য অন্তরা আহমেদ।
বৈঠকে বক্তব্য রাখেন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির উপ-পরিচালক স্বপন কুমার নাথ, প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়ক নাজরানা চৌধুরী হীরা, এসইআইডি’র পরিচালক কারিশমা আহমেদ, ব্র্যাকের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার লামিয়া দেওয়ান, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের জাহিদুল করিম, এসডিএসএলের হাসিবা হোসেন জয়া প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ‘র্যানডমাইজড ট্রায়াল অন দ্যা ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ পভার্টি গ্র্যাজুয়েশন মডেল বেজলাইন’ রিপোর্ট শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে- ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে না। এছাড়া এসব পরিবারের মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ৭৫ শতাংশ কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। আর শিক্ষার আওতায় আসা ৩৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর ১৫ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বাক্ষর জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ।
মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুব কম সংখ্যক প্রতিবন্ধী শিশুই লেখাপড়া করে। তাদের জন্য বিশেষ করে সরকারি ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়াটা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আমি বলবো কাজ শুরু হয়েছে। এ কথা সত্য আমরা প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সেভাবে চিন্তা করে অবকাঠামো নির্মাণ করিনি। তবে প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়ে উভয়ের কথা ভেবেই কাজ করছি। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, সমস্যা যেমন আছে তেমনি সমাধানও আছে। শিক্ষা কারিকুলামের সংস্কার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করলেও তা আমরা জানি না। প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিশেষ যে সক্ষমতা আছে তা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সেই সুযোগটা আমাদের করে দিতে হবে।
প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, প্রতিবন্ধকতা জয় করে সফল্যের শিখরে উঠেছেন এমন উদাহরণ বিশ্বে রয়েছে। তবে আমরা প্রতিবন্ধীদের জন্য তেমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি। একবারেই যে তা পারবো তা নয়। তবে আশার কথা হলো কাজ হচ্ছে।
শ্যামল দত্ত বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। প্রতিবন্ধীতা জয়ের কিছু সফল উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। কিন্তু এই সাফল্য আমরা সর্বত্র দেখতে চাই। এজন্য প্রয়োজন পুরো বাংলাদেশকে প্রতিবন্ধী বান্ধব করে গড়ে তোলা।
বক্তারা বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বইসহ শিক্ষকের ব্যবস্থা থাকলেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী কোনো শিক্ষক নেই। ফলে এই স্তরের শিক্ষার্থীরা কিছুদিন স্কুলে গেলেও ক্লাসের পাঠ বুঝতে না পেরে পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী অধিকার সুরক্ষা আইন-২০১৩তে সমন্বয় কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। কিন্তু আদৌ এই কমিটি গঠিত হয়নি। এছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা কত এ নিয়েও রয়েছে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি। বলা যায়, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ এখনো জরিপের বাইরে।
প্রতিবন্ধী নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৮টি সুপরিশ তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, ঝড়ে পড়া রোধসহ বিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপযোগী প্রবেশগম্যতা ও যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কার্যকর অংশগ্রহণে শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ চাহিদা পূরণে সাধারণ শিক্ষা কাঠামো সংস্কার, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ, মেধা ভিত্তিক ভর্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য কোটা সংরক্ষণ, প্রতিবন্ধী নারী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে বিশেষ শিক্ষা ভাতার ব্যবস্থা, প্রজনন স্বাস্থ্য, ঋতু ব্যবস্থঅপনা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদা বিবেচনায় তাদের ব্যবহার উপযোগী শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত ও বিনামূল্যে বিতরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।