ঘরে মমতাময়ী, বাইরে অপরাধীদের আতঙ্ক

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০, ০১:৩০ এএম

পুলিশে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ফাইল ছবি

আশরাফি তানজিনা

রাশেদা আক্তার বাবলী

ফরিদা পারভীন
‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ এই প্রবাদ এখন একেবারেই সেকেলে হয়ে পড়েছে। নারীরা এখন রাঁধা আর চুল বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে বাঘও শিকার করতে পারে। ঘরে যেমন মমতাময়ী তেমনি কখনও দেবী দূর্গার মতো নারীকে দশ হাতে সবকিছু সামলাতেও দেখা যায়। তবে মায়া-মমতায় ঘরকে সামলিয়ে এখন রাষ্ট্রকেও সামলাচ্ছেন নারীরা।
বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমাজের আগল ভেঙে এখন এগিয়ে এসেছেন তারা। বাংলাদেশ পুলিশে নারীরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তেমনি উল্লেখযোগ উন্নতিও হয়েছে। সাতপাকে বাঁধা পড়ে, শতপাকে জড়িয়েও পুলিশে কর্মরত নারীরা শুধু দেশেই নয়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমেও প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন।
বাংলাদেশই বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ, যা প্রথম নারী পুলিশের সম্পূর্ণ কন্টিনজেন্ট পাঠিয়েছে। আর বাংলাদেশ পুলিশে নারীরা শুধু অপারেশনাল কাজেই নয়, পলিসি লেভেলও কাজ করছেন। তারা সাহসিকতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন নিজেদের চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব আর কর্তব্য। কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তারা পুরস্কৃতও হচ্ছেন।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ পুলিশে দুই লাখের বেশি সদস্যের মধ্যে নারী রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি। যা মোট সংখ্যার ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগরে (ডিএমপি) নারীদের মধ্যে ৮২৫ জন কনস্টেবল, নায়েক ৮ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ১১ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) ৯০ জন, ইন্সপেক্টর ৭ জন, সহকারী কমিশনার ৬ জন, অতিরিক্ত উপকমিশনার ১৮ জন ও উপকমিশনার পদে ৪ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা ভোরের কাগজকে বলেন, নারী ও শিশুর সেবা দানে পুলিশের কর্মক্ষেত্রসমূহ অনেক সহায়ক ও যুগোপযুগী হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় পুলিশে নারীর ভুমিকা দিন দিন আরো বেশি আলোকিত হচ্ছে।
ঘর আর সংসার সামলেও কর্মক্ষেত্রে কিছু নারী পুলিশ অসামান্য আবদন ও সাহসিতার পরিচয় রাখছেন। তাদের মধ্যে ডিএমপির ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের সবুজবাগ অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আশরাফি তানজিনা, নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ফরিদা পারভীন ও ডিএমপির এএসআই রাশেদা আক্তার বাবলীকে নিয়ে আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এ আয়োজন।
আগে থামা শিখতে হবে: আশরাফি তানজিনা সারদাতে অশ্বাহরণ প্রশিক্ষণের সময় ঘোড়াকে দৌড়ানোর আগে আমি থামাতে শিখেছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঘোড়াকে দৌড়ের সময় থামাতে না জানলে পড়ে গিয়ে আমাকে আহত হতে হবে। তাই কর্ম ও সাংসারসহ পারিপার্শ্বিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যেক নারীকে আগে থামতে শিখতে হবে। যাতে তার আহত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। কথাগুলো বলছিলেন ৩৩ম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেয়া আশরাফি তানজিনা। [caption id="attachment_207373" align="alignnone" width="700"]আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, অনেকেই হয়তো রেগে প্রশ্ন করতে পারেন- থেমে যেতে হবে মানে? না, এখানে থামা মানে স্থির হয়ে যাওয়া নয়। থামা মানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কৌশলী হয়ে সামনের দিকে সমান তালে এগিয়ে যাওয়া।পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফি তানজিনা এখন ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের সবুজবাগ অঞ্চলের ১৪১ জনের একটি ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুলিশে কোনো বৈষম্য নেই উল্লেখ করে তানজিনা বলেন, আসলে আমিও গৃহিনী। তবে দুই ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক। সারদায় প্রশিক্ষণকালীন ১১ ফিটের একটি দেয়াল লাফ দেয়া ছাড়া ছেলে সদস্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে হয়েছে আমাকে। ওই কারণেই এখন নিজেকে যে কোনো কাজের যোগ্য বলেই মনে হয়। কর্মজীবনের কথা উল্লেখ করে আশরাফি তানজিনা বলেন, শুরুতেই র্যাবে দায়িত্ব পালন করি। এখন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে। আমার অধীনে এখন ১৪১ জন কাজ করছে। সেখানে নারীর নেতৃত্ব মেনে নিতে অনেকে অপ্রস্তুত থাকলেও আমাকে তা জয় করতে হয়েছে। তানজিনা বলেন, সকালে নিয়মিতই ঘুম ভাঙে ওয়াকিটকির শব্দে। শুরু হয়ে যায় কাজ। ডিউটিতে ঠিতমতো কে কোথায় পৌঁছাচ্ছেন বা সড়কের কি অবস্থা ম্যাসেজ আসতে শুরু করে। এর মধ্যেই উঠে রেডি হয়ে বের হতে হয়। সবাই ঠিকমতো ডিউটি করছে কি না- এমন তদারকিসহ অন্যান্য আরো কাজ শেষে অফিসে ঢুকতে হয়। এরপর চলতে থাকে দিনব্যাপী কার্যক্রম। এমনো হয়েছে সকালে এসে কাজের চাপে বাসায় ফিরতে হয়েছে গভীর রাতে। ট্রাফিকের মতো একটি ব্যস্ততম বিভাগের দায়িত্বে থেকেই সংসার সামলানো- এ বিষয়ে নারী কর্মকর্তা আশরাফি তানজিনা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে স্নাতক অধ্যায়নের সময়েই আমার বিয়ে হয়ে যায়। ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার কিছুদিন পরই আমার মেয়ে রাইতা জামানের জন্ম। মেয়ে-সংসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্যারালাল পড়ালেখা। এর মধ্যেও আমি স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে ১৫তম ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চম হই। সাড়ে ৪ বছরের মেয়ে রাইতা জামানকে রেখে সারদায় ট্রেনিংয়ে যাই। এখন আমার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আমার স্বামী একজন ব্যাংকার। আসলে কর্মজীবী নারী বা মায়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও দায়িত্বগুলো ভাগ করে নেয়া একটি বড় বিষয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেয়া।আশরাফি তানজিনা[/caption]
জঙ্গি হামলাও দমাতে পারেনি বাবলীকে গাইবান্ধা সদর থানার মেয়ে এএসআই রাশেদা আক্তার বাবলী। গত ২০০৮ সালে পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেয়া এ নারী ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হন। গত ২০১৯ সালের ২৬ মে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ের সামনে দায়িত্ব পালনের সময় জঙ্গিদের দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা হামলায় আহত হয়েছিলেন বাবলী। বাম পায়ে স্প্রিন্টারবিদ্ধ হয় তার। কিছুদিন পর দেখা দেয় ইনফেকশন। তবে বোমার আঘাত এ নারী পুলিশের মনোবল ভাঙতে পারেনি। পুরো উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। [caption id="attachment_207374" align="aligncenter" width="700"]বাবলী ভোরের কাগজকে বলেন, নারী হিসেবে ভেবে কাজ করিনি। করেছি শুধু পুলিশ হিসেবে। নারী হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে কখনোই দায়িত্ব পালন থেকে পিছ পা হইনি। পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে কাজ করে গেছি। বেশি হাঁটলে বাম পা ফুলে শক্ত হয়ে যাওয়া ছাড়াও ব্যথা করে। জোরে শব্দ শুনলে একটু ভয়ও হয়। বোমা বিস্ফেরণের কথা মনে পড়ে। তবে সব উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছি নিজেকে আরো এগিয়ে নিতে। বাবলী বলেন, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছি ডিএিমপি কমিশনারের কাছ থেকে। পড়াও চালিয়ে যাচ্ছি। রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছি। সাত বছরের মেয়ে ঐতিহ্য ও একই পেশায় কর্মরত স্বামীকে নিয়ে সংসার করছি। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল নারীর প্রতি আমার ম্যাসেজ থাকবে- নারী-পুরুষ বিষয় নয়, আসলে হলো নিজেকে এগিয়ে নেয়া ও যোগ্য প্রমাণ করা। আমি মনে করে, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী।রাশেদা আক্তার বাবলী[/caption]
বইমেলায় ফরিদা পারভীনের ‘ভালোবাসা কথা কয়’ নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ফরিদা পারভীন। ১৯৮৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামালপুরের সরিষাবাড়িতে জন্ম। তবে বাবার চাকরির সূত্র ধরে বড় হয়েছেন টাঙ্গাইল সদরে। বাবা আবদুর রাজ্জাক, পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির প্রকৌশলী এবং মা নিলুফা ইয়াসমিন একজন সাধারণ গৃহিনী। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় তিন কন্যা সন্তান। সমাজের প্রচলিত রীতি উপেক্ষা করেই মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তাদের মানুষের মতো মানুষ করাই ছিল ব্রত। [caption id="attachment_207381" align="alignnone" width="700"]বাবার চাকরির সূত্রে ফরিদা পারভীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা টাঙ্গাইলে। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ তার ভালো ফলাফলের জন্য মেধা পদকে ভূষিত করেন। ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে ফরিদা পারভীন সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে নৌপুলিশ ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন। ফরিদা পুলিশের মতো ব্যস্ত পেশায় থেকেও পরিবারকে সময় দেন। দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি নৌ পুলিশের লিগ্যাল, মিডিয়া এবং ট্রেনিংয়ের দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া নৌপুলিশের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। বিয়ের প্রায় চার বছরের মাথায় স্বামীকে হারান। সে সময় তার দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তান ছিল। অন্যদিকে সাড়ে চার মাসের অনাগত সন্তানকে শরীরে ধারণ করে ওই কঠিন সময়েও নিজেকে ধীরে ধীরে প্রমাণ করেছেন। বর্তমানে তার তিন বছরের কন্যা রাইম ও এক বছরের পুত্রসন্তান রোরিকে নিয়ে খুব সাহসিকতা ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। এতকিছুর পরেও লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন। এবার একুশের বইমেলায় তার প্রথম কবিতার বই ‘ভালোবাসা কথা কয়’ প্রকাশিত হয়েছে।ফরিদা পারভীন[/caption]