শহরে কাজ নেই, গ্রামে বন্যা- কোথায় যাবে ওরা?

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২০, ০৮:৪৫ পিএম

টুনির মা, শামীম শেখ আর খাদিজা

টুনির মা

শামীম শেখ

খাদিজা
করোনাকাল আমূল পাল্টে দিয়েছে প্রান্তিক মানুষের জীবন। বিবর্ণ হয়ে গেছে, যাচ্ছে তাদের সব স্বপ্ন-সম্ভাবনা। নগরায়নের পথ ধরে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে একদিন তারা ভিড়েছিলেন যাদুর শহরে। আজ সেই স্বপ্নঘেরা শহরটা ফাঁকা, সম্ভাবনাহীন, বিরান। জীবন-জীবিকা থেকে ছিটকে পড়া ‘পরগাছা’ মানুষ ছুটছেন ফেলে আসা গ্রামে, বাড়তি ‘উপদ্রব’ হয়ে। আর যারা গ্রামের শিকড় ছিঁড়ে একেবারেই শহরকে করেছিল আশ্রয়, তারা আজ যেন ‘বেওয়ারিশ’ মানব। করোনার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত রাজধানীর এমনই সব মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন ভোরের কাগজ লাইভের প্রতিবেদক পাপলু রহমান। লিখেছেন তাদের দীর্ঘশ্বাসের কথা।
গ্রামে আসি কী করবু বইন ধরলাপাড়ের জেলা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর এক অজপাড়াগাঁ থেকে সেই কবে ছিটকে পড়েছিলেন টুনির মা (৪০)। এক ধাক্কায় স্বামীর সঙ্গে এসে ঠাঁই নিয়েছেন রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। কোলজুড়ে টুনি আসার পর বাবা-মায়ের দেয়া ‘শিল্পী’ নামটাও হারিয়ে গেছে তার। এখন সবাই বলে ‘টুনির মা’। করোনামহামারি এসে প্রতিদিন চোখ রাঙাচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে, শহরের বস্তি থেকে উপড়ে ফেলতে চাইছে তাদের।
চোখে মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। তবুও জানতে চাই পরিস্থিতি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ভোরের কাগজ লাইভকে বললেন, একটা হোটেলে রান্নাবান্নার কাজে সহযোগিতা করতাম। করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে সেটি। স্বামীরও কাজ নাই, আয়ও নাই। তিন মাসের ঘরভাড়া জমে গেছে। বাসাবাড়ির কাজেও কেউ নিচ্ছে না।
এমন ‘ঘাড়ধাক্কা’ পরিস্থিতিতে টুনির মা আবারো ফিরতে চেয়েছিলেন ফেলে আসা গ্রামে। কিন্তু সেখানেও যে বাধা। বললাম কীসের বাধা? গ্রামে থাকা ভাইয়ের বক্তব্য উল্লেখ করে বললেন, আমার ভাই ফোনে কয়, গ্রামে আসি কী করবু বইন? গ্রামেও তো কিছু নাই। এখন তো বন্যা আইছে। আমরাই তো মরতাছি।
[caption id="attachment_230724" align="aligncenter" width="700"]
গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া উপায় কি! টুনির মায়ের ঘরের পাশেই একটা দর্জিখানা। এটি চালান যুবক শামীম শেখ। করোনা হানা দেয়ার আগে পরিবার নিয়ে দিনকাল চলছিল তার ভালোই। দিনভর মনের আনন্দে কাজ করতেন। তবে করোনার কারণে গত চার মাসে কাজ কাম কমে গেছে। আর আয় গিয়ে ঠেকেছে তলানীতে। পরিবারের ভরণ পোষণ, দোকানভাড়া আর ঘরভাড়া দিতে গিয়ে দিশেহারা।
হতাশায় মলিন চেহারা শামীম শেখের। মুখের দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকাতেই বললেন, তিনমাসের দোকানভাড়া-ঘরভাড়া অহনও দিতে পারি নাই। কেমনে দিমু তাও জানি না। গ্রামের বাড়ি যাওয়ারও পথ খোলা নাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হয় এখান থেকে চুরি করে পালাইতে হইবো, নাইলে গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে হইবো। একথা বলতেই গলাটা তার বুজে এলো। নীরব কান্না এসে গলায় আটকে গেল।
[caption id="attachment_230725" align="aligncenter" width="700"]
পান পঁইচা যাইতেছে, বেচবার পারি না বেলা পশ্চিমে ঢলে পড়লে ফুটপাতে পিঠাপুলি নিয়ে বসতেন খাদিজা। টুকটাক যা আয় হতো তাতেই চলতো মা-মেয়ের জীবন। স্বামী অনেক আগেই ছেড়ে গিয়ে অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী করেছেন। খাজিদার সঙ্গীহীন জীবনের স্বপ্ন আরেক দানব এসে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। করোনাকাল শুরু হলে তার পিঠাপুলির দোকানে বেচাবিক্রিতে ভাটা পড়ে। কেউ আসে না পিঠা খেতে। বাধ্য হয়ে পিঠার বদলে পান-সিগারেটের ডালা নিয়ে বসতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। শহরে মানুষ নাই, জন নাই, তাই বেচাবিক্রিও নাই।
অসহায় মুখটি তুলে খাদিজা বলেন, ভাইরে পিঠার দোকানটা আর চলে না। তাই পান-সিগারেট বেচতেছি। এক প্যাকেট সিগারেট শেষই হয় না। এক প্যাকেট শেষ হলে ৩ থেকে ৫ টাকা লাভ হয়। আর পানতো পঁইচা যাইতেছে, বেচবার পারি না।
গেল চারমাস ধরে ঘরভাড়া দিতে পারছেন না খাদিজা। কবে দেবেন তাও জানেন না। চাপ দিচ্ছেন বাড়িওয়ালা। বলেন, ইচ্ছে করে এ শহর ছেড়ে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাই। কিন্তু পারি না, মেয়েটির জন্য। ওর তো একটা জীবন আছে।
[caption id="attachment_230728" align="aligncenter" width="700"]
টুনির মা, শামীম শেখ কিংবা খাদিজার মতো অসংখ্য মানুষ এখন রাজধানীর অলিতে গলিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। কারোনা কবে বিদায় হবে সেই আশায় বসে আছে। কেউবা শহর ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াচ্ছেন। (চলবে)
আরো পড়ুন-