জিয়ার মদতেই হত্যাকাণ্ড

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৭ এএম
খুনি মাজেদের চাঞ্চল্যকর জবানবন্দি।
রাতের নৈঃশব্দ। শিশুপুত্র রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের জন্মদাতা। ঘুমাচ্ছিল বাংলাদেশ। শুধু জেগেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। ঘাতক এজিদ, সীমার আর দুর্যোধনের অট্টহাসিতে বিদীর্ণ হয় রাত্রির নিস্তব্ধতা। স্বাধীনতা আর সম্ভাবনার প্রাণশক্তি কেড়ে নিতে ধানমন্ডি ৩২-এর ৬৭৭ নম্বর বাড়িটিতে হামলে পড়ে মানুষরূপী হায়েনার দল। কৃষ্ণপক্ষের নিকষ আঁধারে পৈশাচিক তাণ্ডবে স্তব্ধ করে দেয়া হয় সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপুরুষকে। ঘাতকদের বুলেটে পিতৃশূন্য কলঙ্কিত ভূমিতে পরিণত হয় রক্তে কেনা বাংলাদেশ। ইতিহাসের এই কঙ্ককজনক অধ্যায় তৈরির কুসন্তানরা, কিলিং মিশনের কুশীলবরা আজ সত্যের মুখোমুখি।
পনের আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের বয়ান থেকেই। আর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে, এই বার্তা স্পষ্ট করে গেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ।
ক্যাপ্টেন মাজেদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, জাতির পিতাকে খুন থেকে শুরু করে, হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করার বিষয়টিও ছিল জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনার অংশ। গত বছর ১২ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর অজানা কাহিনী।
ইতিহাসের গর্হিত এই হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বারবার আড়াল করার চেষ্টা করে গেছেন খুনি মাজেদ। তবে খুনিদের দেয়া সব সুবিধা ভোগ করে গেছেন। সেনেগালেরর রাষ্ট্রদূত করার বিষয়টি তার পছন্দ হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে মাজেদের ইচ্ছানুযায়ী দেশে ফিরিয়ে এনে উপসচিব পদমর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে পদায়ন করা হয়। সবশেষ যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক করা হয় তাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকে ৮ এপ্রিল সোমবার গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২২ থেকে ২৩ বছর ধরে তিনি কলকাতায় ছিলেন বলে জানা যায়।
ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের দেয়া জবানি প্রায় হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো- ‘১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সাহেব ১০-১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে সব ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এর জোয়ান এবং অফিসারদের এডড্রেস করেন। ওখানে উনি (জিয়াউর রহমান) মোটিভেট করেন যে, ‘এখন যে ঘটনা গত রাতে ঘটে গেছে তোমরা সে সব নিয়ে কোনো রকম মাথা ঘামাবে না। তোমরা সব চেইন অব কমান্ডে ফিরে যাও। সবাই কাজকর্ম কর। এটা জাতির ব্যাপার এটা আমাদের ব্যাপার না।’ এভাবে উনি (জিয়াউর রহমান) মোটিভেটেড লেকচার দিয়েছেন ওখানে ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে। উনি বঙ্গভবনে খুনিদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেন এবং খুনিরাও ওখান থেকে যোগাযোগ করতেন ডাইরেক্ট এবং আর্মির চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না। ওরাই চালাত প্র্যাকটিক্যালি। ওখান থেকে।
ওনার (জিয়াউর রহমান) সঙ্গে মাঝখানে একবার আমি ইন্টারভিউ দিতে যাই সেনা হেডকোয়ার্টারে। সেখানে উনি, ওনাকে (জিয়াউর রহমান) বললাম যে, আমাকে আমার একটা বাহিরের সিভিল সার্ভিসের ব্যাপারে ওনাকে অনুরোধ করেছিলাম। সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তখন ওনার (জিয়াউর রহমান) সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তখন দেখা গেছে যে তিনি প্র্যাকটিক্যালি এই ক্যুয়ের পক্ষপাতসুলভ কথাবার্তা বলছেন। ওদের পক্ষ হয়ে কথা বলছেন। এটা করেছেন কিন্তু উনার (জিয়াউর রহমান) কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে- দেখা গেছে যে উনি ক্যু’র সমর্থক। ওদের সঙ্গে ওনার সবকিছু যোগাযোগ ছিল। পরবর্তী সময় যখন বিদেশে যাওয়ার প্রশ্ন আসলো তখন তিনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গভবনে। ডাইরেক্ট কথা বলতে পারি না ওনার সঙ্গে। উনি দেখি মিলিটারি সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওনারা কথাবার্তা বলছেন। তো এসব আমরা দূরে থেকে দেখেছি।
পরে (জিয়াউর রহমান) বলল যে এখানে বঙ্গভবনে যেসব অফিসার আছে তারা সবাই বিদেশে যাবে। বিদেশে তাদের উনি কাগজপত্র তৈরি করার জন্য মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন তখন ব্রিগেডিয়ার মাশহুর হক, উনাকে নির্দেশ দিছেন আরকি। যেহেতু আমরা বঙ্গভবনে ডিউটিতে ছিলাম, স্কট ডিউটি; আমাদেরও ব্যাংককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যাংককে যাওয়ার পরে সেখান থেকে আমাদের ফেরত পাঠায়নি; বরং সেখান থেকে শুনলাম যে তখন তো জিয়াউর রহমান সাহেব পুরো ক্ষমতায়। তিনি (জিয়াউর রহমান) তাদের লিবিয়ায় আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। পরে আমরা শুনলাম সেখানে জেলখানায়ও তারা ৪ জন জাতীয় নেতাকে মেরে গেছে। এই রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওখানে ঘোষণা করছে, বলছে তার সঙ্গে দুজন সিপাইও ছিল। সিপাইরা তো ওখানে যাওয়ার কথা নয়। সিপাই, তারপরে রিসালদার।
তারপর লিবিয়াতে আমরা গিয়েছি। লিবিয়ায় যাওয়ার পরে বলে যে, ফরেন সার্ভিস হবে সবার। জিয়াউর রহমান ফরেন সার্ভিস দিবেন সবাইকে প্রাইজ হিসেবে এবং একটা করে প্রমোশনও দিয়ে দিবেন। পরে কিছুদিন পরে কয়েক মাস আমার মনে নাই এক্স্যাক্ট ডেট, সেই জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধি জেনারেল নুরুল ইসলামকে (শিশু) পাঠায়। জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু যায় সেখানে। ওদের সঙ্গে মিটিং করে। কার কার কোথায় ফরেন পোস্টিং হবে সেই চয়েজ নিতেই তিনি গেছেন ওখানে। জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে।
জিয়াউর রহমান, উনার ডাইরেক্ট মদত ছিল ওদের প্রতি। উনি তো ওদের টোটাল পেট্রোনাইজড, একটা করে প্রমোশন জাম্পড এবং একটা করে ফরেন প্রাইজ পোস্টিংগুলো, এগুলো তো অফিসাররা ফরেন সার্ভিসের জন্য কোয়ালিফাইড নয়। এটা তো সত্যি কথা। তো ফরেন সার্ভিসের জন্য এসব অফিসার কোয়ালিফাইড নয়, মোস্ট অব দেম শর্ট সার্ভিস কমিশনড অফিসার। অল্প কতদিনের, ইভেন তারা গ্র্যাজুয়েটও না। তাদের ফরেন সার্ভিস হিসেবে প্রাইজ পোস্টিং দিচ্ছে। এটাতে বুঝা যাচ্ছে যে উনি (জিয়াউর রহমান) পুরো ওদের সঙ্গে একদম সংযুক্ত। আর লেয়ার থেকেই ওনার সঙ্গে কথা।
এগুলো উনার (জিয়াউর রহমান) কথার ধরনে বোঝা যায়। তারা (ক্যু অফিসারের পরিবার) বঙ্গভবন থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের। তাদের জন্য পাসপোর্ট, মাই গড পরিবার শুধু? বিয়ে করে নাই তারা চলে গেছে। অন্য মহিলারা তাদের ফিয়ান্সে, গার্লফ্রেন্ড এ ধরনের এগুলো আর কি কথা বলব, এ ধরনের, ওই বিয়ে হয়নি। মেজর শাহরিয়ার বিয়েও করে নাই। এক ভদ্রলোকের ওয়াইফকে নিয়ে চলে গেছে। সেসব কাগজপত্র পর্যন্ত তাদের বানিয়ে দিয়েছে। আবার ওই যে, আরেকটা মেজর হুদা অবশ্য পরে গেছে তার ওয়াইফ। বিয়ে হয়নি কিছুই হয়নি নারায়ণগঞ্জের এক মেয়ে হুদার ওয়াইফ বলে গেছে। পরে তার ওয়াইফ জয়েন করে। তাকে কাগজ করে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ওখানে। এসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে বোঝা যাচ্ছে যে এগুলো এখান থেকে হচ্ছে।
উনি (জিয়াউর রহমান) ছাড়া তো আর এগুলো হতে পারে না তখন। উনি (জিয়াউর রহমান) যেহেতু আর্মি চিফ, এরা আর্মি অফিসার। বিয়ে ছাড়া এসব মহিলা একোম্পানি করছে। যাদের ওয়াইফ ছিল, চিলড্রেন ছিল তাদের ব্যাপার ভিন্ন। এরাও একোম্পানি করেছে। আমরা লক্ষ করেছি ওনার (জিয়াউর রহমান) ওয়াইফ ক্যান্টনমেন্টে। ৭১ সালে উনার ওয়াইফ উনি তখন মনে হয় চিটাগাং ছিলেন। ওনার ওয়াইফের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে ১৯৭২ সালে যখন উনি কুমিল্লায়। ওখানে ক্যান্টনমেন্টে ছিল চিটাগাংয়ের। উনি তো ৭২ সালে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের। ওখানে আমরা দেখেছি।
অ্যাজ এ ব্রিগেড কমান্ডার ওয়াইফ হিসেবে যখন রিসিপশন হতো তখন দেখেছি। উনি (খালেদা জিয়া) শুনেছি যে, উনি ৭১ সালে উনি ইয়েতে ছিলেন। তো এখানে জিয়াউর রহমানের এসব বক্তব্যগুলো। আমি ওনাকে (জিয়াউর রহমান) দুই/তিনবার দেখেছি। উনার বক্তব্য শুনেছি। অডিটোরিয়ামে সামান্য কয়েক মিনিটের জন্য শুনছি। আমরা বাইরে দিয়ে দাঁড়ানো ছিলাম। ওখানে উনি বক্তব্য রাখছেন। অনেক লোক সেখানে। ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে। জায়গা হয়নি, জায়গা খুব কম ছিল। ওখানে জায়গা ভর্তি। যারা আগে বসে গেছে বসে গেছে। আমরা তো পরে গেছি। ক্যু পার্টি সেখানে ছিল না। উনি (জিয়াউর রহমান) ক্যান্টনমেন্টে যে জওয়ানরা ছিল আর অফিসাররা ছিল তাদের মোটিভেট করার জন্য।
ওই মোটিভেট ছিল, যেটা ঘটনা হওয়ার হয়ে গেছে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। ফারদার কোনো কিছু যেন না হয়। না হলে তো তখনি, তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা সিপাইও ইয়ে করে নাই। তারা তো জানেও না এসব। তাদের তো কোনো অফিসাররা ক্যু’তে ইনভলব ছিল না। তারা ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিটায়ার্ড অফিসার কিছু ছিল। দুজন-তিনজন। আর বাকিরা ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্মড কোরের লোক। ওরা ছিল না, ক্যু অফিসাররা ছিল না। ওখানে যারা ক্যু’তে ছিল না তারা ছিল। বক্তৃতা দিয়েছেন, মোটিভেট করেছেন। ওনার (জিয়াউর রহমান) তো সমর্থন আছে তা না হলে উনি আগ বাড়িয়ে এসব মোটিভেশন করবে কেন ওনাদের? উনার (জিয়াউর রহমান) তো সমর্থনই, এ তো পরিষ্কার কথা। এখানে সাবসিকুয়েন্স তারা অ্যাকশনই তো বোঝা যায়। এখানে ওদের প্রতি তো ওনার (জিয়াউর রহমান) সমর্থন ওদের প্রতি। রেগুলার ওরা ওরাই ডিক্টেক্ট করত সব কিছু। হুকুম চালাত ওখান থেকে। ওরা যাই চাইত তাই উনি (জিয়াউর রহমান) করে দিত। এ ধরনের অবস্থা ছিল তখন। এতেই তো পুরো ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। একদম পরিষ্কার করে সব নাম, সব অফিসারের প্রত্যেকটার নাম ঘটনা ইভেন শহীদ খালেদ মোশাররফকে কারা কারা শহীদ করছে ওনার (জিয়াউর রহমান) সেটাও আছে।
আমরা শুনেছি যে উনি (শহীদ খালেদ মোশাররফ) বলছেন, ওই মেজররা শুধু শুধু বঙ্গভবনে বসে থাকবে কেন? কেন ওখানে। তারা চলে আসবে। তারা চলে আসুক। ইউনিটে চলে আসবে। তারা কমান্ডে চলে আসবে ফিরে। তার একটা ন্যায্য দাবি। সঠিক দাবি, চেইন অব কমান্ড। চেইন অব কমান্ড ছাড়া ফোর্স চলে নাকি? যে যে অফিসারই করছে আছে, কিন্তু এদের সমর্থন ছিল। এরা এসব ঘটনার সঙ্গে মূলহোতা। এরা এসব কিছু করছে। এদের সব কিছু ভিআইপির মতো ট্রিটমেন্ট দিত। তারা বঙ্গভবনে ভিআইপি। উনাদের (ক্যু পার্টির সদস্যদের) ছিল সামনে। প্রেসিডেন্টের ভিআইপিরা যে গেট দিয়ে ঢুকে সামনের গেট, ফ্রন্ট গেট। প্রেসিডেন্টের পাশে রুমে স্যুইট মোশতাক সাহেবের যে রুমে থাকতেন সেই পাশে ছিল। আমরা তো কখনো দোতলায় উঠিনি। দোতলায় এখান দিয়ে উঠে ডাইরেক্ট লিফট। লিফটে উপরে যেতেন এবং এখানেই কথোপকথন হতো আর্মির সঙ্গে এবং জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে।
জিয়াউর রহমান এলেও এখানে এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। এই বঙ্গভবনে এলেই ওনাদের (জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ক্যু পার্টির সদস্যদের) সঙ্গে মিটিং হতো এখানে। ক্যুয়ের পরে বঙ্গভবনে ওই সামনের ফ্রন্ট গেট দিয়ে উনি এই জিয়াউর রহমান যখন আসতেন আমরা তো পেছন থেকে খবর পাইতাম। দেখতাম সবকিছু। এই গাড়ি দিয়ে নামছে উনি উঠে উপরে চলে যেতেন ওই ক্যু নেতাদের উপরে চেম্বার ছিল, রুম ছিল। তারা যে থাকত সেখানে মিটিং করত তাদের সঙ্গে।