পানি জাহাঙ্গীর সম্পর্কে বেরিয়ে এলো আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ০৫:৩৬ পিএম

৪০০ কোটির পিয়ন পানি জাহাঙ্গীর।। ছবি: সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার বাসায় কাজ করা পিয়ন, যে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। হ্যাঁ, এটা বাস্তব কথা। সে কী করে বানালো এই টাকা! যখনই আমি জেনেছি তাকে বাদ দিয়ে কার্ড-টার্ড সব সিজ করে ব্যবস্থা নিয়েছি। ধরা পড়লে তো চোখে আসে। তা ছাড়াতো হয় না। যখন ধরা পড়ে তখন ব্যবস্থা নিই। রবিবার (১৪ জুলাই) সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে- এমন উদাহরণ দিতে গিয়ে নিজ বাসার সাবেক এক কর্মীর দুর্নীতি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারপ্রধানের এমন তথ্যের ভিত্তিতেই ব্যাপক আলোচনায় আসেন সেই পিয়ন মো. জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীর। ঠিক তখনই প্রশ্ন ওঠে যে কিভাবে একজন পিয়ন ৪০০ কোটির মালিক হন, আবার তিনি হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। শেখ হাসিনা পরিচয় খোলাসা না করলেও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সেই পিয়নের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে নিশ্চিত করা গেছে যে পানি জাহাঙ্গীরের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নাহারখিল গ্রামে। তার বাবার নাম রহমত উল্যা এবং মায়ের নাম অজিফা খাতুন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের প্রথম দুই টার্মের পুরোটা এবং তৃতীয় টার্মের প্রথম কিছু দিন প্রধানমন্ত্রীর পারসোনাল এইড হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সরকারের ওই টার্মের প্রথম দিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারি দপ্তরে চাকরি না থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে জাহাঙ্গীরের নামে। বিষয়টি নজরে এলে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে সবাইকে সতর্ক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া অনুসন্ধানে একের পর এক উঠে আসে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধান বলছে পানি জাহাঙ্গীর ৯০ দশকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি সুধাসদনে আসা দলীয় নেতাকর্মীদের পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন। নেতাকর্মীরা তখন তাকে ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে চিনতেন। পরবর্তীতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান। এরপরই যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পান তিনি।
জাহাঙ্গীরের বাবা ইউনিয়ন পরিষদের সামান্য কেরানী হিসেবে চাকরি করতেন। সংসারে ছিল টানাপোড়ন। দল ক্ষমতায় আসার পর তার উত্থান অনেকের কাছে আলাদীনের চেরাগের মতো। চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। জেলা শহরের মাইজদীতে আছে আটতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন।
আরো পড়ুন: এবার আবেদ আলীর আরেক বড় কুকর্ম ফাঁস
আরো পড়ুন: আমি কোনো দুর্নীতি করিনি: মতিউরের স্ত্রী লাকী
মূলত, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু সবসময় নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়েই করতেন বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য। নানা উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনও করেছেন তিনি। এমনকি ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন দলীয় নেতাকর্মীদের কাছেও। ভুয়া পরিচয়ে একসময় বাগিয়ে নেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদও। গত কমিটিতে সহ-সভাপতির পদে ছিলেন তিনি। নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলার অনেক উন্নয়ন কাজ।
একই পরিচয়ে জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। তার ভাই দীর্ঘদিন ধরে খিলপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান। ভাগিনা মাকসুদুর রহমান শিপন জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান। দুটি পদই জাহাঙ্গীরের ক্ষমতার জোরে বাগিয়ে নেন তারা। তার দাপটে তাদের বিরুদ্ধে কেউ নির্বাচনে পর্যন্ত দাঁড়ায়নি। ভাগিনা শিপনও মামার জোরে এলাকায় বেশ দাপুটে।
তাছাড়া এলাকায় পুলিশ প্রটোকলে চলতেন পানি জাহাঙ্গীর। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে তুলে ধরতেন। আর সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করতেন। বিভিন্ন সময় দেয়া তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যেতেন, কী করতেন, সরকারপ্রধান কোন সময় কী করতেন তা তুলে ধরতেন। দরিদ্র ও চালচুলোহীন পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দান করতেন দুই হাতভরে।
জাহাঙ্গীর ঘুরতেন লাইসেন্সকৃত পিস্তল নিয়ে। নানা তদবির করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। একপর্যায়ে রাজনীতির মাঠে নামেন পিয়ন জাহাঙ্গীর। চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য নমিনেশন তোলেন। সেটা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তবে পরবর্তীতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। নোয়াখালী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহীমের বিরোধিতা করেন জাহাঙ্গীর। তাকে হারানোর পাঁয়তারার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজধানীতে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে জাহাঙ্গীরের। ধানমন্ডিতে তার স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে।
নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে জাহাঙ্গীরের আটতলা বাড়ি রয়েছে। সেটিও তার স্ত্রীর নামে। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল বহর নিয়ে করতেন সভা-সমাবেশ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যান জাহাঙ্গীর। যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন তিনি। ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়া মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার।
আরো পড়ুন: আবেদ আলীর প্রশ্নফাঁসে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন যারা
আরো পড়ুন: এনবিআরের প্রথম সচিবের বিপুল সম্পদের সন্ধান, ৭০০ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন
মিরপুরে সাততলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে জাহাঙ্গীরের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান তিনি। সবমিলিয়ে বছরে তার প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানানো হয়।
নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নামে আড়াই কোটি টাকা এবং তার স্ত্রীর নামে ব্যাংকে সোয়া ১ কোটি টাকা রয়েছে। ডিপিএস আছে পৌনে ৩ লাখ টাকা। এফিডিআর রয়েছে সোয়া ১ কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন জাহাঙ্গীর। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। এছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করেন জাহাঙ্গীর। গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরের এলাকার অনেকে জানান, একসময় তাদের পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। বর্তমানে তিনি অঢেল সম্পদ ও টাকার মালিক। এসবই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে। তারা আরো জানান, জাহাঙ্গীর বলতেন, তার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী ও দলীয় অনেক নেতার সখ্যতা রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক মন্ত্রী বা দলীয় নেতা ওর দ্বারস্থ হতেন বলেও তিনি বলতেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জাহাঙ্গীরের মতামত জানতে মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয়া হলেও রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য লিখে পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। তার ঘনিষ্ঠজনরা দাবি করেছেন, জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।