আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ করছে পুলিশ: অ্যামনেস্টি

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০২:১৪ পিএম

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ করছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ করছে পুলিশ। সারা দেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বুধবার (১৭ জুলাই) এসব কথা জানানো হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ শুনেছে অ্যামনেস্টি। পাশাপাশি ঘটনার ভিডিও-ছবি বিশ্লেষণ, সত্যতা যাচাই করে দেখেছে অ্যামনেস্টি ও তাদের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব। এসব বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের বেআইনি বলপ্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
এই সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে বলে মনে করে এমনেস্টি। প্রতিষ্ঠানটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক গবেষক তকবীর হুদা বলেন, শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবি জানানো আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে অ্যামনেস্টি।
তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন এবং নিজেদের সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকার অনুসারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদের অধিকারের প্রতি সম্পূর্ণভাবে সম্মান দেখাতে হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের আরো ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে হবে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, চলমান সংঘর্ষে গত ২দিনের বিক্ষোভে অন্তত ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামনেস্টির সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে পারে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলা শুরুর আগে আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ করছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল ও বিজয় একাত্তর হল থেকে ছাত্রলীগের সদস্যদের রড, লাঠিসোঁটা, এমনকি পিস্তল নিয়ে বের হয়ে আসতে দেখা গেছে।
এর আগে ২০২৩ সালে অ্যামনেস্টি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার বিবরণ নথিভুক্ত করেছিল। সেই সহিংসতার সঙ্গে এই সহিংসতার বিবরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছে সংস্থাটি।
অ্যামনেস্টি সড়কে, হাসপাতালের ভেতরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ভিডিও যাচাই করেছে, যা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণকে সমর্থন করে। অ্যামনেস্টির যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ১৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টাকালে কিছু ছেলে তাদের হাত থাকা অস্ত্র তুলে ধরেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আহত অন্য আন্দোলনকারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় হামলার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে পুলিশ হাসপাতালেই ছিল, কিন্তু ছাত্রলীগ পুলিশের সামনেই জরুরি বিভাগে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। রাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে নামিয়ে দিয়েছে, আমরা যতবারই প্রতিবাদে নামি, সেটা ২০১৮ বা ২০২৩ সালের প্রতিবাদই হোক না কেন, আমাদের দমন করার শক্তি হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিবারই।’
নিরাপত্তার কথা ভেবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আশা করি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল কর্তৃপক্ষ আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরা রেজিস্টার ভবনের সামনে ছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওপর থেকে আমাদের ওপর নজর রাখতে দেখেছি। আমরা পালানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু অফিস ভবনগুলোতে তালা লাগানো ছিল। আমরা ভেতরে ঢুকতে দিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেউ দরজা খোলেননি। এটা শুধু ব্যর্থতা নয়, ছাত্রলীগের সহিংসতার সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা আছে বলেই আমি মনে করি।’
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন অ্যমনেস্টিকে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর বয়সী প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তিনি অবিরাম বমি করছিলেন, তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওই শিক্ষার্থীর সাদা জামা রক্তে পুরোপুরি ভিজে গিয়েছিল। এসময় তার পকেট থেকে মুঠোফোন উদ্ধার করা হয় যেটি টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছিল বুলেটের আঘাতে।
এর আগে রংপুরে আবু সাঈদ নামের ২৫ বছর বয়সী এক ছাত্র নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। অ্যামনেস্টির যাচাই করা দুটি ভিডিওতে অন্তত ২ জন পুলিশ সদস্যকে রাস্তার ওপার থেকে সরাসরি শটগানের গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। অ্যামনেস্টি সাঈদ ও পুলিশের অবস্থানের ব্যবধান বোঝার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি (ইমেজ) ব্যবহার করে। এতে দেখা যায়, গুলির সময় সাঈদ ও পুলিশ সদস্যের মধ্যকার দূরত্ব ছিল অন্তত ১৫ মিটার। ঘটনার সময় পুলিশের প্রতি কোনো ধরনের শারীরিক হুমকি সৃষ্টি করেননি সাঈদ। তাঁর মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে ‘মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে’।
পুলিশের গুলিতে নিহত সাঈদের ক্ষতের ছবি পরীক্ষা করেছেন স্বাধীন ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট ডেরিক পাউন্ডার। তিনি অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছেন, শটগানের গুলিতে সৃষ্ট ক্ষতের সঙ্গে এর পুরোপুরি সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে।
তকবীর হুদা বলেন, ভিডিও দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে একজন ব্যক্তির ওপর বিনা উসকানির আক্রমণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাঈদ পুলিশের জন্য কোনোভাবেই হুমকি ছিলেন না। যে কোন বিক্ষোভ মোকাবেলায় পুলিশের গুলির যথেচ্ছাচার ব্যবহার অত্যন্ত বিপজ্জনক ও বেআইনি।
যে কোন বিক্ষোভ বা আন্দোলনে শটগান থেকে গুলির ব্যবহারকে কোনভাবেই সমর্থন করেনা অ্যামনেস্টি। কারণ শটগান থেকে ছোড়া কার্তুজে ধাতব ছররা থাকে। এগুলো ত্বকে প্রবেশ করে গুরুতর জখম ঘটাতে পারে। মিসর, ভারত এবং ইরানে একাধিক মৃত্যু, অন্ধত্বের কারণ হিসেবে এই গুলির ব্যবহারকে দায়ী করা হয়।
তকবীর হুদা আরো বলেন, আমরা জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সকল আহত ব্যক্তির পুনর্বাসন এবং যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছি। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত সবার জবাবদিহি অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
আরো পড়েন: ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন বিবেচনার প্রশ্নে মুখ খুলেছে যুক্তরাষ্ট্র
এসব হামলাকারীর ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও দ্রুত তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশের যেসব সদস্য সরাসরি জড়িত বা আইনের লঙ্ঘন প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও নিরপেক্ষ, স্বাধীন, দ্রুত তদন্ত করতে হবে।