×

জাতীয়

‘দেখ তাসরিফ, প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ’

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৩৫ পিএম

‘দেখ তাসরিফ, প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ’

তাসরিফ খান। ছবি: সংগৃহীত

   

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের সাধারণ ছাত্ররা শুরু করলেও একটা পর্যায়ে এ আন্দোলনে দেশের আপামর জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের পাশাপাশি এতে অংশগ্রহণ করেন দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের একটি বড় অংশ। তরুণ সংগীতশিল্পী তাসরিফ খান আন্দোলন চলাকালে ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ শীর্ষক তার পুরনো একটি গানের মাধ্যমে নিজের প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনে সমর্থনের কারণে গত জুলাইয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হন বলেও জানান তিনি। তাঁর ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে বেধড়ক পেটানো হয়, সেই ঘটনারই সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পোস্টে।

শুক্রবার (১৬ আগস্ট) তাসরিফ খান নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বৈষম্য বিরোধী বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে পোষ্ট করেছেন। এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার এই প্রতিবাদ কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে ছিল না। এখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো ইস্যু ছিল না। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আমার এই আন্দোলন। আমি নিজেও কোনো রাজনীতি করি না। একজন শিল্পী হিসেবে আমি আমার শিল্পকর্ম দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসংগতির বিরুদ্ধেই কথা বলেছি। ভবিষ্যতেও যখন আমার চোখে অন্যায় অসংগতি পড়বে, আমি আমার গান দিয়ে প্রতিবাদ জানাবো। শিল্পী হিসেবে দেশে ও সমাজের প্রতি এটাই আমার সবচেয়ে বড় দায় বলে মনে করি।

তাসরিফ খান তার ফেসবুক প্রোফাইলে ‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’ শিরোনামে দীর্ঘ লেখাটি লিখেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট দেয়া, কবিতা লেখা এবং ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটি ফেসবুকে প্রকাশ করায় সরকারি গুণ্ডা বাহিনীর হুমকিতে ৫ জুলাইয়ের পর তিনি কার্যত বাসা থেকে পালিয়ে যান।  

ঘটনাটি ২৩ জুলাই রাত ১টার কথা উল্লেখ করে তিনি শুরুতেই লিখেন, ‘একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললেন, ‘তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।’ ওই ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে, আমি তখন বাসার সামনে আসি, দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জন মানুষ নেমে আসেন। ইনফ্লুয়েন্সার আমাকে পাশে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলেন, ‘সাথে যারা আছেন, তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কয়েকজনও আছেন এখানে।’ 

আমি তখন তার কাছে জানতে চাই যে ‘তারা কেন এসেছেন, কী চাচ্ছেন মূলত! তিনি তখন বুঝিয়ে বলেন, ‘সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরো ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকব। আমরা ঠিকমতো বাচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হবে, এর বাইরে কোনো রাস্তা নাই।’ এই কথা বলে তিনি আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। 

সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলেন, ‘তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিচ্ছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা।’

সেই ইনফ্লুয়েন্সারও ৬-৭ জনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাকে বলেন, ‘দেখ তাসরিফ, প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যত দিন আছে, সুবিধা পাবি।’ কথা শেষ করার আগেই তিনি পকেট থেকে ১ লাখ টাকার ৩টি বান্ডিল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইটা সামান্য ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর।’

এরপর তাসরিফ এও লিখেন, ‘ঠিক এই সময় মোবাইলে আমারই ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নম্বর থেকে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তাসরিফ! ৫–৬ জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!’ 

শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়া কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখানো? নাকি শুধুমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? 

শান্তর লাইন কেটে যায়। আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেয়া লোকদের বলি, ‘ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে! 

ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আরে! দেশের যে অবস্থা, এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে।’ আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি তাঁদের টাকা ফিরিয়ে দিই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা চাইলেই আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারেন। তাই মাথা ঠাণ্ডা করে তাদের বলি, ঠিক আছে আমি দেখছি, কী করতে পারি। কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। 

তারা আমাকে তখনো একরকম হুমকি দিয়ে বলেন, ‘জানাচ্ছির সুযোগ নাই! অবস্থা তো বোঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে।’ সঙ্গে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলেন, ‘তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে, সো বুইঝা–শুইনা সুন্দর কইরা করিস।’

পোস্টে তাসরিফ লেখেন করেন, রাতে তাদের সঙ্গে কথা বলে বাসায় যান। এরপর চিন্তা করতে থাকেন, কী করবেন। পরিস্থিতি সামাল দেবেন কীভাবে। 

সেই ঘটনার বর্ণনার দিয়ে তাসরিফ লিখেছেন, ‘বাসায় ফিরে সবাইকে অবস্থা জানিয়ে আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিতকে ফোন দিয়ে বলি,‘আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নম্বর দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়ে দিয়ে দিবি, কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি; কারণ, আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’ 

ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা-ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মু, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সঙ্গে বেইমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে, সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সঙ্গে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই আর্তনাদ।’

ড্রামার শান্তর ঘটনার উল্লেখ করে তাসরিফ লিখেছেন, ‘ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন দিয়ে বলছিল, ‘খান, আমার বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুরবেলা খাওয়া হয় নাই, একটা দোকানও খোলা নাই, আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে, কী করব?’ আমি শান্তকে বলছিলাম, ‘এক বড় ভাই ফোন দিয়েছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে, তো তুমিও আমার বাসায় চলে আসো-দুই ভাই একসঙ্গে খাব।’

তাসরিফ বলেন, ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে, অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়কভাবে মাইর খাইতে হলো। মার খাওয়ার পরে ফোনকলে সে আমাকে এটাও বলছিল, ‘খান! সবাই আমারে একসঙ্গে রোল দিয়ে মারতেছিল আর একজন বন্দুক তাক করে চিৎকার করে বলছিল, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা, নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইব না তোর পরিবার!’ শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদছিল, ‘আমাকে ছাত্র বইলা বইলা ওরা মারছে, আর বারবার বলতেছিল যে এই অমুকের পোলা ছাত্র! ওরে মার!’

পোস্টের শেষের দিকে ২৩ জুলাই রাতে পালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তাসরিফ লিখেছেন, ‘ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই।  আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ এর মতো কিছু গান করা ছাড়া, দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে গিয়ে বুক পেতে দিতে পারিনি। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয় নাই। তবে আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হই নাই, আর দেশের সঙ্গে বেইমানিও করি নাই।’

শনিবার দুপুরে তাসরিফ গণমাধ্যমকে জানান, এমন পোস্ট দেয়ার পর ওই অভিযুক্ত ইনফ্লুয়েন্সার ফোন করেন তাকে। অনুরোধ করেছেন, তার নাম, পরিচয় যেন প্রকাশ করা না হয়। 

তাসরিফ বললেন, আমিও সেই নামটা প্রকাশ করতে চাই না। কারণ, তার পরিবার আছে। এরপর হয়তো অনেকের দ্বারা তার প্রতি ও পরিবারের আক্রমণ হবে, পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা ছাড়া ক্ষমতার প্রভাবে যখন তিনি আমার ক্ষতি করেছেন, তখন আমি একা ক্ষতিগ্রস্ত হইনি, আমার পুরো পরিবার সেই ভোগান্তির স্বীকার হয়েছে, সেই কষ্টটা কতটুকু, তা আমি জানি। আজকে জেনেশুনে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসলে তার পরিবারকেও একই রকম কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে পার করতে হবে, তা আমি চাই না। 

আরো পড়ুন: ১০০ টাকার চরিত্র থেকে সরে গেলেন অপু বিশ্বাস!

তাসরিফ বলেন, এমনটা যদি করিও, তাদের সঙ্গে আর আমার সঙ্গে তো পার্থক্য থাকল না। আমি আর কোনো প্রতিহিংসা চাই না। তিনিও তার ভুল বুঝুক, সংশোধিত হোক এটাই আমার চাওয়া। তবে এও চাই, তিনি যেন জনবিচ্ছিন্ন হন, ইতোমধ্যে তিনি সেটা হয়েছেনও বলে আমার বিশ্বাস।

টাইমলাইন: কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App