আয়নাঘরের রহস্য উন্মোচন করলেন সেই আতাউর

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৪ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বাঙালির ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী আতাউর রহমান শাহিন। ভারত থেকে কম্পিউটার সাইন্সে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে একটি কনসালট্যান্সি ফার্মে কাজ শুরু করেন। তার কাজের দক্ষতা দেখে মাঝে মাঝে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকেও ডাক আসত। কিন্তু ২০১৯ সালের ২ মে, গুলশান লিংক রোড থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। সেই সময় তার স্ত্রী তানিয়া ছিলেন ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
অপহরণের পর আতাউরের স্ত্রী মন্ত্রী, স্পিকারের বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বামীর খোঁজে গেছেন, কিন্তু কোনো সহায়তা পাননি। বরং অনেক সময় দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে। ৯৪ দিন পর আতাউরকে চোখ বেঁধে ক্ষিলখেত এলাকার একটি জায়গায় ছেড়ে দেয়া হয়।
বন্দি অবস্থায় আতাউর কী ঘটেছিল তা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ২০১৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সার্ভার সেটআপ করে দেন। বন্দি হওয়ার এক সপ্তাহ আগে তাকে আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করা হয়। সেখান থেকে বলা হয়—ভাই, আমাদের এখানে একটা মেইল আসে, মেইলটা ডিজিএফআইয়ের কাছে চলে যায়। আমরা ট্রেস করতে পারছি না। আমাকে একটু ঐদিনের রিপোর্ট জেনারেট করে দিতে বলে। আমি দুই-তিন পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট করি এবং আমার জিমেইল থেকে ওদের মেইল করি। ওরা সম্ভবত মনে করে ডিজিএফএইকে মেইল আমিই করি।
বন্দি হওয়ার দিন ৭টা সাড়ে ৭টার দিকে আমি কাজ শেষ করে পাঠাও বাইকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম—এমন সময় একটি মাইক্রোবাস এসে আমার সামনে থামে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে ৪ জন আমাকে ধাক্কা মেরে মাইক্রোবাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। আমার মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দেয়। চোখে যাতে না দেখি তার জন্য আরেকটি মাক্স পরায়। আমাকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দেয়। এক জন আমার পায়ের ওপর বসে পড়ে। একজন আমার বুকের কাছে রিভলবার ধরে। ওরা কয়জন ছিল আমি জানি না। তবে সবাই মিলে আমাকে জোর করে ধরে রাখে যে আমার ব্যাকপেইনটা বেড়ে যায়।
ওরা আমাকে ঢাকার অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জায়গাতে নিয়ে আসে। সেখানে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আমাকে নিয়ে যায়। আগে থেকেই কেউ অপেক্ষা করছিল। শুরু হয় আমাকে প্রশ্ন করা—২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দিয়ে প্রশ্ন করা শুরু হয়। ওরা জানতে চায়, আমি এই বিষয়ে সরকারবিরোধী কোনো পোস্ট দিয়েছি কি না। তখন আমি বলি—না। আমি ছাত্র না, আমি কেন ওরকম পোস্ট দেব। আমি আমার মোবাইল দিয়ে চেক করতে বলি। ওরা আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুঁজে কিছু পায় না।
আয়নার ঘর, যেখানে আতাউর বন্দি ছিলেন, সেটির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, দৈর্ঘ্যে সাত ফিট আর প্রস্থে চার ফিটের একটি ঘরে কেটেছে ৩ মাসের বেশি সময়। দরজার দুই পাশে দুইটা ফ্যান ছিল তবে সেটাতে কোনো বাতাস হতো না। এই ফ্যান চালালে বাইরের কী হচ্ছে, বোঝার মতো অবস্থা থাকত না। ঘরের ওপরে লাইট যেটা ছিল, সেটা অনেক ভোল্টেজের। মনে হয় চোখ বন্ধ করলেও আলো চোখে চলে আসে। ঘরের দেওয়ালে ছিল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। পাশের ঘরগুলো প্রায় প্রতি রাতেই শুনতেন আর্তনাদের শব্দ। ঘরটিকে কবরের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, কবরে গেলেও দুনিয়ার কারো সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না, এখানেও ঠিক তাই।
আরো পড়ুন: রবিবার দেশের সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে
আয়নাঘর থেকে ফিরেই হারিয়েছেন চাকরি। নিষেধ ছিল নতুন চাকরিতে যোগদান নিয়েও। ছাড়া পেলেও আয়নাঘরের নির্যাতনের কথা পাঁচ বছরেও স্ত্রীকে কিছুই জানাননি। স্ত্রী তানিয়া আক্তার জানান, স্বামীকে হারানোর পর এক দিনও তিনি বাড়িতে থাকেননি। অনেক খুঁজেছেন তাকে। এক ব্যক্তি ফোনে স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়া কথা বলে ২ লাখ টাকা দাবি করে। দেনদরবারের পর ধার করে ১ লাখ টাকা তাকে দেয়া হয়। এরপর সরকারের সব পর্যায়ে কথা বললেও কোনো সমাধান হয়নি। ৯৪ দিন পর একটি সিএনজি নিয়ে বাড়ি ফেরেন স্বামী। এরপর কেটেছে ৫ বছরের বেশি সময়। পরিবর্তন হয়েছে সরকারের, সাহস হয়েছে মুখ খোলার। এখন বিচার চান আতাউর।