স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরছে স্থবির হওয়া পার্বত্য অঞ্চল

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার জের ধরে অশান্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য অঞ্চল। খাগড়াছড়িতে শুরু হওয়া পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাঙ্গামাটিতেও। দফায় দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটায় ৩ দিনের অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। বন্ধ থাকে বেশিরভাগ দোকানপাট। থমথমে অবস্থা বিরাজ করে পার্বত্য জেলাগুলোয়। সাজেকে আটকা পড়ে দেড় হাজারের বেশি পর্যটক। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়া পাহাড়ি অঞ্চল আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। গতকাল সোমবার ঢিলেঢালাভাবে পালন করা হয়েছে শেষ দিনের অবরোধ কর্মসূচি। পরিবহন ধর্মঘট উঠিয়ে নেয়ায় আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হবে সব ধরনের যানবাহন চলাচল। ফিরিয়ে আনা হবে আটকে পড়া পর্যটকদের। নতুন করে আর কোনো কর্মসূচি না আসায় স্বস্তি ফিরছে জনমনেও।
সহিংসতাকে কেন্দ্র করে সব স্থবির হয়ে পড়ায় শুধু রাঙ্গামাটিতেই ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই ক্ষতি শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে রাঙ্গামাটির বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন ভিক্ষুরা। গতকাল সকালে শহরের বনরূপা এলাকার মৈত্রী বৌদ্ধ বিহারে সংবাদ সম্মেলন থেকে এই দাবি জানায় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি শ্রদ্ধালঙ্কার মহাথের বলেন, গত শুক্রবার হঠাৎ কিছু লোক বিহারে প্রবেশ করে হামলা চালায়। এতে বিহারের পবিত্র বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে এবং বিহারের থাকা দানবাক্স নিয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো স্বাধীন, সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের প্রতি এ ধরনের চরম অবমাননার ঘটনায় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে বড় অন্তরায়। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ, খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, ধর্ম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন এবং পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতন্ত্রায়ন নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। এদিকে গতকালও দূরপাল্লার যানচলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। তবে অবরোধকে কেন্দ্র করে কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। আগুন দেয়ার চার দিন পর গতকাল সকাল থেকে খাগড়াছড়ির লারমা স্কয়ারে পণ্য বিক্রি শুরু করেছেন বিক্রেতারা। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, অবরোধের শেষ দিন কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। নিরাপত্তা জোরদারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। আর রাঙ্গামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেখানে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে দূরপাল্লার যান ছেড়ে গেছে। রাঙ্গামাটির ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটি শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত চারটি বাজারকে কেন্দ্র করে। পাহাড়ের বাসিন্দারা তাদের উৎপাদিত ফসল ও পণ্য এসব বাজারে বিক্রি করেন, কিনে নেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। সাম্প্রতিক সহিংসতার জেরে গত শুক্রবার থেকে এসব বাজার কার্যত বন্ধই ছিল। এছাড়া পর্যটকদের কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটিতে ব্যবসা জমে ওঠে। সহিংসতায় ছেদ পড়েছে সেখানেও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু তিন দিনেই তাদের ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই ক্ষতি শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রাঙ্গামাটির প্রাণকেন্দ্র বলা হয় রনরূপা বাজারকে। শুক্রবার সহিংসতা শুরু হয় এই এলাকা থেকেই। সংঘর্ষ চলাকালে দুর্বৃত্তদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনরূপা ও আশপাশের ছোটবড় অন্তত ১০০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তছনছ করে দেয়া হয়েছে কাঁচাবাজারের ৫০টির বেশি অস্থায়ী দোকান।
বনরূপা বিএম শপিং কমপ্লেক্সের সাধারণ সম্পাদক এম এস জাহান লিটন বলেন, বনরূপা বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বাজারের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ হয়েছে। পাশাপাশি ১৪৪ ধারা জারি ও আতঙ্কে তিন দিন পুরোপুরি অচল ছিল সব। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা খুব নাজুক অবস্থায় আছেন। তিন দিনে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।
রাঙ্গামাটি শহরের তৃতীয় বৃহৎ বাজার তবলছড়ি। এই বাজারে কোনো হামলার ঘটনা না ঘটলেও তিন দিন ধরে প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বেচাকেনা শূন্যের কোঠায়। তবলছড়ি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইকবাল করিম বলেন, আমাদের বাজারে দুইশ দোকান রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন একেকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি ২০ হাজার টাকার বেশি। সেই হিসাবে ক্ষতি ৪০ লাখ টাকা। একইভাবে আমাদের কাছে যারা পণ্য নিয়ে আসেন তাদের ক্ষতিও প্রায় সমান।
রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ২ অক্টোবর পর্যন্ত ৬০টি রুমের সবই বুকিং ছিল। কিন্তু জাতিগত সংঘাত, অবরোধসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সব ধরনের বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। আবাসন ও রেস্টুরেন্ট খাতে পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের দৈনিক ক্ষতি প্রায় ৪ লাখ টাকা। সেই হিসেবে তিন দিনে ক্ষতি ১২ লাখ টাকা, যা আগামী ১৫ দিনে অর্ধ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সেই নয় রাঙ্গামটিতে প্রায় ৫০টি হোটেল মোটেলের অবস্থা একই। এসব হোটেল পর্যটক সংখ্যা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। হোটেল-মোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, দেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাদের ব্যবসায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
আরো পড়ুন: সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাবে
উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট ভোরে জেলা সদরের শালবন এলাকার বাসিন্দা মামুনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে পিটিয়ে আহত করার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সেই ঘটনার জের ধরে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সহিংসতায় ৪ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হন।