৪০ দিনের মধ্যে ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর নির্দেশ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
আগামী জানুয়ারিতেই বিনামূল্যের পাঠ্যবই দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মুদ্রণকারীদের মাত্র ৪০ দিনের সময় দিয়ে এনসিটিবি বলছে, এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপিয়ে দিতে হবে। এর জবাবে মুদ্রণকারীরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আগে যেখানে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য ১৮০ দিন সময় পাওয়া যেত সেখানে এবার মাত্র ৪০ দিন কেন? এই সময়ের মধ্যে কীভাবে বই ছাপানো সম্ভব?
এনসিটিবি বলেছে, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ৪০ দিনের গণনা শুরু হয়ে শেষ হবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। পরের দুই সপ্তাহের মধ্যে ছাপা হওয়া পাঠ্যবই জেলা ও উপজেলায় সরবরাহ করা হবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে উপজেলা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যবই সংগ্রহ করবে। ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়া হবে। কিন্তু মুদ্রণকারীদের মতে, এই সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। সব বই না দিয়ে জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের হাতে এক-দুটি পাঠ্যবই দেয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের হাতে সব পাঠ্যবই যেতে আগামী ফেব্রুয়ারি/মার্চ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগে শুধু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই দেয়া হতো। গত ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করে। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বছরের এপ্রিল-মে মাস থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে তীব্র সমালোচনায় থাকা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে ২০১২ সালের কারিকুলাম ফিরিয়ে আনে। এর ফলে পাঠ্যবইও পরিবর্তন হয়। পরিবর্তিত পাঠ্যবই ছাপাতে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করতে হয়। নতুন কার্যক্রমের বিষয়ে মুদ্রণকারীরা বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব নয়। কারণ পাঠ্যবই ছাপাতে শুধু ছাপার যন্ত্র নয়, কাগজ থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণও লাগে। এই সময়ের মধ্যে এগুলো পাওয়া যাবে না।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী ৭ অক্টোবর থেকে পাঠ্যবই ছাপানোর দরপত্র খোলা হবে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মুদ্রণকারীদের সঙ্গে পাঠ্যবই ছাপানোর চুক্তি হবে। চুক্তি অনুযায়ী ৪০ দিনের মধ্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করতে হবে।
মুদ্রণকারীরা বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপাতে যে পরিমাণ কাগজের দরকার হবে তা পাওয়া যাবে না- এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, গত দুদিন ধরে এনসিটিবি কাগজের মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করছে। আশা করছি পর্যাপ্ত কাগজ পাওয়া যাবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোভিডের সময় এই মুদ্রণকারীরাই ঝুঁকি নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপিয়ে দিয়েছেন। এবারো তারা পারবেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনায়েদ আল মাহফুজ ভোরের কাগজকে বলেছেন, সরকার ৪০ দিনের মধ্যে ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়ার কথা বলতেই পারে। বাস্তবতা বুঝতে হবে। কারণ ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপতে কমপক্ষে ২শ দিনের দরকার। আগের সরকার ১৮০ দিন সময় দিয়েছে। এখন এই সরকার যদি সময় না দেয় তাহলে কষ্ট করেও কাজটি উঠিয়ে দিতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে বেশ কয়েকটি বিষয়ের সমাহার ঘটে। এর মধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া, মিল থেকে কাগজ আনা। সেই কাগজ আবার এনসিটিবির চাহিদামতো হতে হবে। এছাড়া অনেক মুদ্রণকারী আছেন যারা দরপত্রের মাধ্যমে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পেলেও টাকার অভাব থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ নিতে হয়। কিন্তু এবার পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য মাত্র ৪০ দিন সময় পাওয়ায় সব নির্ধারিত সময়ে না-ও মিলতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুদ্রণকারী ভোরের কাগজকে বলেন, প্রায় ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপাতে অন্তত ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজের দরকার। এর মধ্যে সরকার এবার পাঠ্যবইয়ের কাগজে ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস চেয়েছে। কিন্তু দেশের ৪-৫টি কাগজের কারখানাতেই শুধু এমন কাগজ তৈরি হয়। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সাড়ে ৮শ লটে এই বই ছাপাতে এত কাগজ পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, চাইলেই কাগজ তৈরি করা সম্ভব হয় না। কারণ কাগজ তৈরিতে যে পাল্প ব্যবহার হয় সেটি বিদেশ থেকে আনতে হয়। তা আনতে প্রায় দুই মাস লাগে। এ অবস্থায় দেশে বর্তমানে যে পাল্প আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টন কাগজ উৎপাদন করা যাবে। তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে এনসিটিবির সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না। এনসিটিবির বক্তব্য হচ্ছে, কাজ পেয়ে থাকলে ৪০ দিনের মধ্যেই বই ছাপিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ দিনের শেষে মুদ্রণকারীদের ঘাড়ে বিপদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকাশক বলেন, আগে ১৮০ দিনের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়া যেত। তাতে ব্যাংকঋণ নিয়ে কাজ শুরু করে এনসিটিবিকে এক প্রস্থ বই ছাপিয়ে দিয়ে বিল তুলে ব্যাংকে পরিশোধ করা যেত। তাতে অনায়াসে একজন ছোট মুদ্রণকারীও বিনামূল্যের বই ছাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এবার মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে বই ছাপিয়ে দিতে হবে। এত কম সময়ের মধ্যে ব্যাংকঋণও পাওয়া যাবে না। আর অর্থনৈতিক যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ব্যাংকও কতটুকু ঋণ দিতে পারবে তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। সব মিলিয়ে এবার বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে মুদ্রণকারীরা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন।
আরো পড়ুন: সংস্কার কমিশনের কাজ শুরুর আগেই মতামত নেবে সরকার
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করলেও নতুন করে আর কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রের তথ্যমতে, এরই মধ্যে পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সম্পূর্ণ কাজ শেষে সংশ্লিষ্টরা এনসিটিবির কাছে তা হস্তান্তর করবেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশোধিত বইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম থাকবে না বলে জানায়। সেই হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর রচিত বইগুলোতে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে কিছু আধেয় (কনটেন্ট) বাদ দেয়ার পাশাপাশি মূল্যায়নের পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধনে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ করে দেয়া হয়।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, এই গ্রুপ সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শুরু করে। কিন্তু তারা এই কাজ শেষ করে কার কাছে হস্তান্তর করবে, কাজের দায় কে নেবে এসব বিষয় সামনে এলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজে সমন্বয় করা; কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই কমিটি নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। এরপরে কমিটিই বাতিল করা হয়।