রাষ্ট্রপতির ‘অপসারণ’ যেভাবে সম্ভব

ডয়চে ভেলে
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার প্রায় তিন মাস পর বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গত সোমবার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথভঙ্গের অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর' বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছে। এই দাবিতে মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিকেলে তারা শহীদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে গত বছরের ২৪ এপ্রিল ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে তিনি জতীয় সংসদ ভেঙে দেন, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান। তবে শেখ হাসিনা লিখিতভাবে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন কিনা এই বিতর্ক ছিল।
সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুররীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। রাষ্ট্রপতি বলেন, বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়ত সময় পাননি।
রাষ্ট্রপতির এই কথা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। তবে গত সোমবার রাতে বঙ্গভবন থেকে দেয়া এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যান শেখ হাসিনা। সংবিধানের ৫৭ (ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হয়। এতদিন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন বলেই ধারণা করা হয়েছে। ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানও জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। তাই এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই পদত্যাগ করেছেন। তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন যে আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। ফলে তিনি পদত্যাগ করেছেন কি করেন নাই সেই বিতর্ক খুবই অপ্রাসঙ্গিক।
তিনি বলেন, তবে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তার নিয়োগকারী সংসদই তো নাই। এখন তিনি পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নাই। আবার অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কীভাবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর কথা, তবে এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নাই। তাই রাজনৈকি দলসহ সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে এটা হতে পারে। পরের সংসদ এসে এর বৈধতা দেবে।
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, এখন স্পিকার নাই, ডেপুটি স্পিকার নাই। ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন। এখানে একটা শূণ্যতা আছে। এক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি। নেসেটিটি এটাকে লিগ্যাল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার যে রায় আছে সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে। আর তাকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ নাই। যেহেতু পার্লামেন্ট নাই। পার্লামেন্ট ছাড়া তো আর অভিসংশন হবে না।03:33
শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিতর্ক নিয়ে তিনি বলেন, এটা নিয়ে আসলে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভাষণে বলেছেন। আবার বঙ্গভবন একটি প্রেসনোট দিয়েছে।
তবে ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, যেহেতু সংবিধান বহাল আছে তাই সংসদ ছাড়া তার পদত্যাগ অথবা অভিসংশন সম্ভব নয়। স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। সংসদ নাই। তাকে যদি অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় সরানো হয় তাহলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে।
তিনি বলেন, আমার মতে; এরই মধ্যে একধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কারণ যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে। তারা সাংবিধানিক নয়। সংবিধানে এধরনের সরকার নাই। আর শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে থাকেন, যদি চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী কারা দায়িত্ব নেবেন তা কিন্তু সংবিধানে আছে। সেটা অনুসরণ করা হয়নি।
মানব জমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমার মনে হয়নি রাষ্ট্রপতি আমাকে কোনো উদ্দেশ্য থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বলেছেন। উনি যা সত্য তা বলেছেন। তার মনের কথা তো আর আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়নি ওনার মধ্যে কোনো দূরভিসন্ধি আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে উনি সহজ সরল।
তিনি বলেন, আমি চেষ্টা করছিলাম শেখ হাসিনা পদত্যাগ পত্রে কী লিখেছেন তা জানতে। আমার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই তিনি আমাকে পদত্যাগপত্র তার কাছে না থাকার কথা বলেছেন।
বিএনপি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবী ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বিতর্ক নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা বিএনপি পর্যবেক্ষণ করছে। এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের দলের নীতি নির্ধারকরা পর্যবেক্ষণ শেষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেবেন।
তিনি বলেন, এখানে নানামুখী ষড়যন্ত্র আছে। চক্রান্ত আছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসর, বিদেশি গোষ্ঠী এখনো সক্রিয়। তারা ছাত্র জনতার বিপ্লব, গণতান্ত্রিক যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিউস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, আসলে এখন শেখ হাসিনার পদত্যাগ এই বিষয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগও কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এখন যেটা দরকার তা হলো প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো দ্রুত শেষ করা। এরপর দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। আসলে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে এই সরকারকে মূল কাজ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা আছে, থাকবে। সেই ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। মূল কাজে মনোযোগ দিতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ করা না করা এখন আর কোনো ইস্যু না। আর রাষ্ট্রপতি একজন সম্পাদককে যা বলেছেন তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু ওনার দপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে তা আবার পরিস্কার করা হয়েছে। রষ্ট্রপতি যদি তার বক্তব্যে অটল থাকতেন তাহলে শপথ ভঙ্গ হতো।
তিনি বলেন, তবে সবাই যদি মনে করেন, একমত হন তাহলে ডকট্রিন অব নেসেসিটির জায়গা থেকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি একই ব্যক্তি হতে পারেন। যেভাবে ওয়ান ইলেভেনের আগে অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।