বৈষম্যবিরোধীদের 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে বিএনপিতে নানা সন্দেহ কেন

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪০ পিএম

এর সঙ্গে বিদেশি কোনো শক্তির ইন্ধন আছে বলে তারা মনে করেন না। ছবি : সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের 'জুলাই ঘোষণাপত্র' প্রকাশের উদ্যোগ আপাতত সফল না হলেও এ উদ্যোগের পেছনে কারা তা নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ ও আলোচনা দানা বেঁধে উঠেছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ মাস পর এসে ঘোষণাপত্র নিয়ে তোড়জোড় ও বিশেষ করে 'বাহাত্তরের সংবিধানকে কবর দেয়ার হুমকি'তে দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। তাদের অনেকে মনে করেন এই উদ্যোগের সঙ্গে নির্বাচনকে বিলম্বিত বা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টারও যোগসূত্র থাকতে পারে।
দলটির ভেতরে এমন বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে কোনো 'বিশেষ রাজনৈতিক দলের' উস্কানি কিংবা ভরসাতেই মঙ্গলবার শহীদ মিনারে জমায়েত ডেকে 'জুলাই ঘোষণাপত্র' প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলো বৈষম্যবিরোধীরা। তবে এর সঙ্গে বিদেশি কোনো শক্তির ইন্ধন আছে বলে তারা মনে করেন না।
গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ৩১শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার বেলা তিনটায় জুলাই বিপ্লবের 'ঘোষণাপত্র' দেয়া হবে বলে জানান। এ সময় তিনি বলেছিলেন যে ঘোষণাপত্রে 'নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে' বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে এবং 'মুজিববাদী সংবিধান কবরস্থ' করা হবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলছেন, বায়াত্তরের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত শাসনতন্ত্র। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এটি অর্জন করেছি আমরা। কেউ এটি অপব্যবহার করলে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা যাবে। কিন্তু বাতিল করার প্রশ্ন আসছে কেন?
দলটির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দেশের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থায় হুট করে 'ঘোষণাপত্র' প্রকাশের পেছনের উদ্দেশ্য আসলে কী? এটা না জানলে তো নানা চিন্তার উদ্রেক হবেই। আবার ঘোষণা দিয়েও করা হলো না কেন। সেটারও বা কারণ কী, বলছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, জুলাই 'ঘোষণাপত্রে' যেসব বিষয় আনার কথা বলা হচ্ছিলো সেগুলোর সঙ্গে বিএনপির যোগসূত্র কম এবং সে কারণেই বিএনপির কাছে এটিকে 'নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি চেষ্টা' হিসেবেই মনে হয়েছে বলে তার ধারণা।
প্রসঙ্গত, বিএনপি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই সংবিধানের সংস্কারের বিষয়ে সতর্ক মন্তব্য করে আসছে। এমনকি আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ 'সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে' এমন মন্তব্য করলে দলটির নেতারা সেটির সমালোচনাও করেছেন।
ঘোষণাপত্র নিয়ে যত ঘটনা
আগস্টের শুরুতে আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আটই আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। শুরু থেকেই বিএনপি সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করে আসছে।
পরে ড. ইউনূস সংবিধানসহ কয়েকটি বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করলে বিএনপি সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশের দাবি জানায়। পরে প্রধান উপদেষ্টা ২০২৫ সালের শেষ বা ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানালেও বিএনপি আরো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার চাপ দিয়ে আসছে।
এর মধ্যে হুট করেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও তাদের সমর্থিত জাতীয় কমিটির নেতারা শনিবার একযোগে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানান যে তারা 'জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' দিতে যাচ্ছেন। পরে রবিবার সংবাদ সম্মেলনে ৩১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় ঘোষণাপত্র প্রকাশের সময় ঘোষণা করা হয়।
এতে হাসনাত আব্দুল্লাহ পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানকে কবর দিবেন তারা। যদিও সরকারের দিক থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, ঘোষণাপত্রের এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি এটিকে 'প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ' হিসেবে উল্লেখ করেন।
হুট করে এমন ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় বিএনপির মধ্যে। সোমবার রাতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
পরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে 'ঘোষণাপত্র' ঘোষণা নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। অপরদিকে সরকারের দুজন উপদেষ্টাও তার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
সোমবারই সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের 'ঘোষণাপত্র' তৈরির ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর দীর্ঘ বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা 'ঘোষণাপত্র' প্রকাশ স্থগিত করে তবে সমাবেশের কর্মসূচি বহাল রাখে।
আরো পড়ুন : যেসব কারণে ঘোষণাপত্র না দিয়ে অন্য কর্মসূচি পালন করলো বৈষম্যবিরোধীরা
বিএনপিতে কেমন প্রতিক্রিয়া
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তা হলো স্থায়ী কমিটির বৈঠকে 'হুট করে ঘোষণাপত্রের বিষয়টি' সামনে আনার ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
এই আলোচনায় কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হলো ছাত্রদের বাইরে থেকে কেউ উস্কানি দিচ্ছে কি না এবং ঘোষণাপত্রের নামে সব দল ও সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বকে সামনে রেখে 'নিজেদের কর্তৃত্ব জাহিরের' চেষ্টা হয় কি না।
একই সঙ্গে ঘোষণাপত্র প্রকাশের নামে 'নির্বাচনের দাবিকে গুরুত্বহীন দেখিয়ে বর্তমান শাসন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার' কোনো অভিপ্রায় দেখা যায় কি না সেটি নিয়েও আলোচনা করেছে দলটির নেতারা। এমনকি সভায় এই প্রশ্নও ওঠে যে সারাদেশ থেকে গাড়ি বোঝাই করে লোকজন এনে বিশাল শোডাউন করার জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে তার উৎস কী।
দলটির নেতাদের কেউ কেউ অভিমত দিয়েছেন, ঘোষণাপত্রের সমাবেশে বিএনপিসহ সব পক্ষ উপস্থিত হলে এবং তাদের সামনে রেখে ঘোষণাপত্র প্রকাশের মাধ্যমে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যা চায় সেটিই হয়' – এমন ধারণা জাতির সামনে দেয়ার চেষ্টা হতে পারে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন তারা এটি নিশ্চিত হয়েছেন, এ উদ্যোগের সঙ্গে বিদেশি কোনো শক্তির যোগসূত্র নেই। তবে দেশের দুটি দলের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে ধারণা করি, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন একজন নেতা।
সভায় এই ধারণাও উঠে আসে যে ছাত্ররা দল করছে ও তারা ক্ষমতায় আসতে চায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন নেই আর জামায়াত ভোটে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিলম্বিত করা গেলে ক্ষমতায় থেকে দল গোছানোর সময় পাওয়া যাবে। সে কারণেই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি হুট করে সামনে আনা হয়েছে বলে মনে করেন দলের একাংশ।
চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বৈষম্যবিরোধীরা তাদের দাবি বা প্রস্তাব সরকারের কাছেই দিতে পারতো। তা না করে তারা একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছে। কিন্তু আমাদের তো জানতে হবে এর পেছনে কারা।
জানা গেছে, সোমবার রাতের দলের স্থায়ী কমিটির সভায় গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বৈষম্যবিরোধীদের ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগকে 'নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রকল্প' হিসেবে অভিহিত করেন।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তারা এখন দেখবেন সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়। সরকার যদি আমাদের ডাকে তখন আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরবো।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের দূরত্ব ও সন্দেহের মূল জায়গাই হলো নির্বাচন। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেদিকে আগ্রহ নেই। তারা দল গঠনের কথা বলছে। তারা ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘসময় ধরে দল গঠনের সুযোগ পেলে সেটি বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা আছে।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধীরা তাদের ঘোষণাপত্রে যেসব বিষয় আনা হবে বলে বলছিলেন সেগুলোর সঙ্গে বিএনপির যোগসূত্র কম, বরং বিএনপি দেখছে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী প্লাটফরম ও তাদের মিত্র নাগরিক কমিটি, সরকার, জামায়াত- সবার মধ্যে একটি অলিখিত ঐক্য গড়ে উঠেছে নির্বাচনের সময়সীমাকে কেন্দ্র করে।
তিনি আরো বলেন, আর এটিই নির্বাচনকে দীর্ঘসূত্রতায় ফেলে দেয়ার চেষ্টা বলে বিএনপির কাছে মনে হতে পারে। সে কারণে সরকার দায়িত্ব নেয়ায় ও বৈষম্যবিরোধী ঘোষণাপত্র প্রকাশ থেকে ব্যাকফুটে আসায় বিএনপি স্বস্তি পেয়েছে।