×

জাতীয়

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক কতটা?

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৬ পিএম

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক কতটা?

ছবি : সংগৃহীত

   

বাংলাদেশে আজ যখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছয় মাস পুরো হচ্ছে, তখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। কারণ দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হতাশ করেছে সাধারণ মানুষকে।

তবে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। দলমত নির্বিশেষে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে; সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছিল 'একনায়কতান্ত্রিক' শাসনের।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের তিন দিনের মাথায় গঠিত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকারও দিয়েছিল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু মানুষের জীবন চলার ক্ষেত্রে বড় দুটি সমস্যা দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে খোদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে। সরকারেরও কেউ কেউ ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন।

ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা সদস্যদের নামিয়েও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বন্ধ হয়নি অনিয়ম-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হলেও অস্থির রয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার।

এমন পরিস্থিতিতে হতাশা থেকে মানুষের মধ্যে ক্ষোভও তৈরি হচ্ছে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদেরও অনেকে এখন মুখ খুলছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুফি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারের কাজ-কর্মে আমরা খুবই হতাশ। মনে হচ্ছ, আমাদের সব শ্রম-ত্যাগ বৃথা হতে যাচ্ছে।

এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও সরকারকে পুরো নম্বর দিচ্ছেন না। প্ল্যাঠফর্মটির অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, গত ছয় মাসে সরকারকে মার্কিং করতে বললে আমি দশে সাড়ে সাত দিবো।

গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটি হচ্ছে 'মব'। এনিয়ে চলছে সমালোচনা। কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না 'মব', ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও। সব মিলিয়ে সরকার আবারো স্বৈরাচারী আমলের দিকে যাচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

সরকার অবশ্য বলছে, তারা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটেই কাজ করে যাচ্ছে।

ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে অংশ নেয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গণহত্যার বিচার ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন হলেও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বাস্তবায়িত হবে। তবে সংস্কারের পুরো কাজ শেষ করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে বলেও উল্লেখ করেন এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, আমি মনে করি শুধু অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার না, বরং পরবর্তী সরকারকেও এগুলো ফেস (মোকাবিলা) করে যেতে হবে।

আরো পড়ুন : সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রিমান্ডে

বাকস্বাধীনতা

আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সরকারের সমালোচনা করার কারণে সেই আমলে সাংবাদিকসহ অনেক মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। জেলও খেটেছেন কেউ কেউ। ফলে ভয়ে সাধারণ মানুষ তখন সরকারের অন্যায়-অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে বা লিখতে চাইতেন না। এমনকি গুমের শিকার ব্যক্তিরা ফিরে এসেও মুখ খুলতেন না।

পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অবশ্য সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিয়ান খান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা আমাদের হারানো বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।

অনেকেই তার এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

দিলশাদ জাহান নামে একজন বলেন, এখন ফেসবুকে কিছু লেখার সময় আগের মতো ভাবতে হয় না। আগে এমনও হয়েছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু পোস্ট করতে গিয়েও করিনি। ডিলিট করেছি। কিন্তু এখন সেটা নেই। নির্ভয়ে সব কথা বলতে পারি, ফেসবুকেও লিখতে পারি।

তবে এখনো ভয় কাজ করে কারও কারও মধ্যে। রিয়াদুল ইসলাম বলেন, সরকার এখন ধরে নিয়ে যাচ্ছে না, সত্যি। কিন্তু অনেক কিছুই এখন বলতে পারছি না মবের ভয়ে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ধরেন, আপনি সরকারের বিপক্ষে ফেসবুকে কিছু লিখলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন একদল আপনাকে আক্রমণ করে বসছে। ফ্যাসিস্টের দালাল তকমা দিচ্ছে। আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নিয়ে কথা বললে রাস্তাঘাটে হামলারও শিকার হতে পারেন। এজন্যও অনেক সময় চুপ থাকতে হচ্ছে।

তবে তিনি আশাবাদী যে, ধীরে হলেও আগামীতে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে।

দ্রব্যমূল্য

দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

ঢাকার ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব বলেন, দাম তো কমেই নাই, অনেক ক্ষেত্রে আরো বাড়ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এই ব্যক্তি আরো বলেন, ছয় মাস আগে যে চাল তিনি ৫৫ টাকায় কিনতেন, এখন সেটি কিনতে হচ্ছে দশ টাকা বেশি দিয়ে। অথচ আমরা আশা করছিলাম, এখন চালের দাম কমবে। কারণ কিছুদিন আগেই ধান উঠছে।

একই কথা বলছিলেন ঢাকার রাস্তায় সিএনজি চালক মোহাম্মদ রিপন। উচ্চমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে তাকে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সারা দিনে যা ইনকাম করি, মহাজনরে দিয়া পাঁচশ টাকাও থাহে না। এডি দিয়া সংসার চালামু, নাকি পোলা-পানের লেহাপড়ার খরচ দিমু?তাইলে ছাত্ররা যে এতকিছু কইলো, এত আশা দেহাইলো, সেডি সব মিথ্যা?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।

আরো পড়ুন : ৪ প্রদেশ, নতুন বিভাগ, সরকার ও ডিসি-ইউএনওসহ যত সংস্কার প্রস্তাব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তারপরও মূল্যস্ফীতি দশ শতাংশের নিচে নামানো সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, সোজা কথায়, সরকার কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় নাই।

সরকার নিজেও অবশ্য সেটি স্বীকার করছে। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি একটু বেড়েছে। কিন্তু নন-ফুডে আবার কিছুটা কমেছে। সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। 

জিনিসপত্রের উচ্চ দামের জন্য চাঁদাবাজিকে দায়ী করছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, চাঁদাবাজিতে এখন তিনটি বড় দল জড়িত। এক, আগে যারা ছিল তারাও আছে… (আওয়ামী লীগের); দুই, যারা এখন পলিটিক্যালি ইমার্জিং…মাঠপর্যায়ে আছে, তারাও চাঁদাবাজি করছে; তিন, স্থানীয় জনগণ। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য ডিফিকাল্ট হয়ে যাচ্ছে।

তারপরও সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ঘুষ-দুর্নীতি

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত, বিশেষত সেবাখাতগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরনো। অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলো মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বললেও বাস্তবে সেটার প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফলে টাকা দিয়েই সেবা নিতে হয়েছে মানুষকে। এবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল।

রেজাউল ইসলাম বলেন, মনে করছিলাম আর হয়তো ঘুষ দিতে হবে না। কিন্তু এখন দেখি যেই লাউ, সেই কদু।

রেজাউল ইসলাম জমি-জমা সংক্রান্ত কাজে সম্প্রতি গিয়েছিলেন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত ভূমি রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে। সেখানকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, পার্থক্য শুধু এটুকুই দেখছি যে, আগে কাজ করতে সরাসরি টাকা চাইতো, এখন নিজে থেকে কিছু বলে না। কিন্তু কাজ না করে আপনাকে এমনভাবে ঘুরাবে যে, আপনি নিজেই বুঝে যাবেন ঘুষ ছাড়া কাজ হবে না।

একই কথা বলছিলেন ঢাকার পান্থপথ এলাকার ফুটপাথের এক ফল ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, হাসিনার পলানোর পরের চার মাসে ব্যবসা করার জন্য কাউরে টাকা দিতে হয়নি। কিন্তু গত দুই মাস ধরে পুলিশ আবার টাকা নেয়া শুরু করছে।

একইভাবে, দেশের অন্যান্য এলাকাতেও চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও অনিয়ম-দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আসলে ব্যক্তি বদলেছে, কিন্তু সিস্টেম বদলায় নাই। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সিস্টেম বদলাতে হবে। সিস্টেম' বদলানোর অংশ হিসেবে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তায়িত হলে আগামী দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।

মানবাধিকার

দেড় দশকের শাসনামলে শেখ হাসিনার সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, অর্ন্তবর্তী সরকারের সময় এগুলো বন্ধ হবে। যদিও বাস্তবে তা ঘটেনি।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ২১ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর।

আরো পড়ুন : রুবেল হত্যা: শাহজাহান ওমর-মামুন-আছাদুজ্জামান গ্রেপ্তার

সম্প্রতি কুমিল্লায় যৌথ বাহিনী তুলে নেয়ার পর তৌহিদুল ইসলাম নামে একজন যুবদল নেতার মৃত্যু হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, গণঅভুত্থান পরবর্তী সরকারের সময় এগুলো মোটেও কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এটা মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং প্রচলিত আইনেই এগুলোর দ্রুত বিচার করা উচিত।

পাঁচই আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গণপিটুনির শিকার হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকেও দলবেঁধে হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

নূর খান লিটন বলেন, এগুলো আমাদের আতঙ্কিত করছে যে, আবার সেই স্বৈরাচারী আমলের দিকে যাত্রা হচ্ছে কি-না।

আইনশৃঙ্খলা

ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে। বিশেষ করে, পাঁচই আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে রীতিমত আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো হয় গত সেপ্টেম্বরে। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আইনশৃঙ্খলা এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

ঢাকার আজিমপুরের বাসিন্দা বিলকিস আরা বানু বলেন, রাতের বেলা তো দূরে থাক, এখন দিনের বেলায়ও পথঘাটে চলতে ভয় হয়। কিছুদিন আগে ভর দুপুরে নিউমার্কেট এলাকা থেকে টান দিয়ে আমার স্বর্ণের চেইন নিয়ে গেছে।

একই কথা বলছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া ঢাকার মগবাজার এলাকার বাসিন্দা উম্মে সালমা হৃদিতা। তিনি বলেন, আগে রাত দশটা-এগারোটার সময় একা চলাফেরা করলেও ভয় করতো না। কিন্তু এখন করে। সে কারণে সন্ধ্যার পর সোজা বাড়িতে চলে আসি।

বর্তমানে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হৃদিতা চলাচলের বাহন হিসেবে স্কুটি বাইক ব্যবহার করেন। ছিনতাই ছাড়াও এখন তার নতুন ভয়ের কারণ 'মব' হামলা।

তিনি বলেন, সংবাদে দেখছি, ধর্মীয় উগ্রপন্থী কিছু মানুষ মেয়েদের ফুটবল খেলতে দিবে না বলে ভাঙচুর চালাচ্ছে। নারী সেলিব্রেটিদেরকেও টার্গেট করছে। স্কুটি চালানো বা চাকরি করার কারণে আমি যে এভাবে টার্গেট হবো না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?," প্রশ্ন রাখেন হৃদিতা।

বৈষম্যবিরোধীরা কী বলছে?

যে চেতনা বা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে বাংলাদেশের মানুষ গত পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিল, সেটি ব্যর্থ হয়নি বলে মনে করে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের কারণেই ইতোমধ্যে অনেকগুলো ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং সরকার এখনও মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে বলে আমরা মনে করি।

তার মতে, গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ব্যক্তি স্বাধীনতায়। তিনি বলেন, মানুষ এখন পরিপূর্ণভাবে বাক-স্বাধীনতা উপভোগ করতেছে। গণমাধ্যমও নির্ভয়ে ক্ষমতাশালীদের প্রশ্ন করতে পারতেছে। পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচারও কমে গেছে।

এক্ষেত্রে মব সৃষ্টি করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার বিষয় উল্লেখ করলে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করা হচ্ছ না। কিছু গোষ্ঠী মব সৃষ্টি করে মতপ্রকাশে বাধা বা বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে। সরকার এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছে।

এদিকে, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে যে মানুষ আশানুরূপ পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়েছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা।

তিনি বলেন, কিছু বাস্তবতা তো অবশ্যই আছে। নানান কারণে পুলিশকে এখনও পুরোপুরি রান করানো সম্ভব হয়নি। দ্রব্যমূল্য নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। তবে অর্ন্তবর্তী সরকারের একার পক্ষে গণঅভ্যুত্থানের সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব না বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে নতুন কাঠামো গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সেজন্যই আমরা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলছি, যার মাধ্যমে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলে সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।

সরকার যা বলছে

গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব প্রত্যাশা পূরণে মানুষ অর্ন্তবর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, সেগুলোর সব যে পূরণ করা সম্ভব হয়নি উপদেষ্টারাও সেটি স্বীকার করছেন।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, এমন একটা গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা বেশি ছিল। তবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সবকিছু অ্যাড্রেস করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক।

কিন্তু ছয় মাসেও প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি কেন?

তিনি বলেন, এখানে অনেকগুলো রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরো বলেন, যারা গণঅভ্যুত্থান করেছে, তারা ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন উপাদান, যেমন: রাষ্ট্রপতি, সংবিধান ইত্যাদি, আর দেখতে চায়নি। কিন্তু এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের জনবিরোধী অবস্থান ও অসহযোগিতার সিচ্যুয়েশন (পরিস্থিতি) এবং মতৈক্য না হওয়ার কারণে অনেকগুলো বিষয় ঝুলে গেছে।

অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও মতপ্রকাশের ওপর আঘাতের ঘটনায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকেই দুষছে সরকার।

উপদেষ্টা অসিফ বলেন, শেখ হাসিনার সময় দীর্ঘ ১৬ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আমাদেরকে সেগুলো পুনরায় দাঁড় করাতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেভাবে মোরাল অবলিগেশনে ফেলে দেয়া হয়েছে, ফলে তারা এখন মাঠে প্রকৃতঅর্থে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এটাকে অনেকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। সরকার এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, বিষয়গুলোকে আমরা দ্রুত অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছি। যারা বাকস্বাধীনতা বা ধর্মীয় স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে, তাদেরকে দ্রুতই আইনের আওতায় আনার জন্য ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের যে সব কথা বলা হচ্ছে, তা মানুষকে কতটা আশ্বস্ত করতে পারবে, সেটা এখনই বলা কঠিন।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App