×

মতামত

প্রতিবেশী কূটনীতি এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:০৮ পিএম

প্রতিবেশী কূটনীতি এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা

সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

   

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ভারত, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে পারে। গত কয়েক বছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা বাড়তে থাকে। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার’ অভিযোগ তোলে ভারত। তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের এমন মন্তব্য ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষও ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন ।

অপরদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক বিদ্বেষমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়—যা এই তিক্ততায় ঘি ঢালে। একপর্যায়ে ভারতের কলকাতা ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন ও সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালানো হয়। অবমাননা করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকারও। বিতর্কিত মন্তব্য করেন ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও। সব মিলিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রকাশ্যে চলে আসে।

সাবেক কূটনীতিকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং আস্থার ব্যবধান কমিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ফলে দুই দেশের জাতীয় স্বার্থে কোনও পরিবর্তন হয়নি। একমাত্র যে পরিবর্তনটি দৃশ্যমান তা হলো—রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাব।

ভারত ও বাংলাদেশকে যে পরস্পরের স্বার্থেই নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, এই উপলব্ধিটা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে । এখন উভয়পক্ষেরই সংযম এবং নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বার্তা দেয়া হচ্ছে যে ঢাকা সুসম্পর্ক চায়, তা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

যদিও অনেকের শঙ্কা, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মানসিকতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে। কিন্তু পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক আদান-প্রদান নতুন সম্পর্ক তৈরির আভাস দিচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধের জায়গাগুলো মীমাংসার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে।

নতুন বছরের প্রথম দিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন—২০২৫ সালে এই তিন বড় শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় অগ্রাধিকার দেয়া হবে। আর ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক কেবল একটি ইস্যুতে আটকে থাকবে না, বরং আরও বিস্তৃত হবে।

দুই দেশের মধ্যে আস্থা, সম্মান ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক নির্মাণে ইচ্ছার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি। গত ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরকালে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সফরকালে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল অংশীদার হলো দুই দেশের জনগণ। বাণিজ্য, কানেকটিভিটি ও অন্যান্য সক্ষমতা বৃদ্ধির খাতগুলোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা ও বহুমুখী সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই করা হবে। এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের অভিমুখ। এরই মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে ইতিবাচক হাওয়া বইছে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বলে দিচ্ছে, নতুন সম্পর্ক বিনির্মাণের পাশাপাশি বিরোধের জায়গাগুলো মিটিয়ে ফেলতে দুই দেশই অঙ্গীকারবদ্ধ।

তবে, অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সব ধরনের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে যে বিষয়টা দিল্লি ও ঢাকাকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে, তা হল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা। দুই দেশের স্বার্থেই সেটা বজায় রাখাটা জরুরি। বাংলাদেশের মতো বড় বাজার ভারত যেমন কখনওই হাতছাড়া করতে চাইবে না, তেমনি বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা ভারী সরঞ্জাম আমদানির জন্য বাংলাদেশও ভারতের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতাই দুটো দেশকে শেষ পর্যন্ত কাছাকাছি রাখবে।

বিশ্লেষকরা বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনুঘটকের ওপর নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তা উদ্বেগের মতো আসন্ন প্রতিকূলতাও সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে।

শুধু ভারত নয় আমাদের সীমান্ত ভাগ করা অপর দেশ মিয়ানমারের সঙ্গেও  পররাষ্ট্র নীতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আরাকান আর্মির রাখাইন দখল। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের দুটি রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের রূপ কী হবে, তা নিয়েও বেশ জটিলতায় পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে।

একইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে চলমান ভূরাজনীতিতে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখাও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

সর্বশেষে বলতে হবে, শুধু কূটনৈতিক ভাষা জানা নয়, বরং সংকট সমাধান, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বোঝাপড়া এবং বৈদেশিক নীতির সমঝোতা গড়ে তোলার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি আন্তর্জাতিক আলোচনায় দক্ষ হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ তার নিজস্ব ঠিকানা খুঁজে পাবে।

বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নয়ন করে বাংলাদেশ বিশ্বপরিসরে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে। সুসংগঠিত আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা সম্ভব। অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে শক্তিশালী আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সুবিধা ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় কূটনৈতিক সমঝোতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করা সম্ভব। আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টায়।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App