×

সাময়িকী

মগ্নতার কথাশিল্পী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৭:১৬ পিএম

মগ্নতার কথাশিল্পী
   

চির বিদায়ে চলে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন বিপুল সম্পদ। সাহিত্যের ভুবনে এই সম্পদ সাহিত্যপ্রেমী মানুষের তৃষ্ণা মেটাবে। বিষয়কে চিন্তা-চেতনায় শিল্পরূপ দেয়ার যে দক্ষতা থাকে সে জায়গাটিকে রিজিয়া রহমান গভীরভাবে আত্মস্থ করেন। লেখালেখির পুরো সময়ে তিনি সেই মগ্নতা থেকে নিজেকে সরাননি। তিনি আমাদের সাহিত্যকে উজ্জীবিত করেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে এর পরিসর বৃদ্ধি করেছেন।

রিজিয়া রহমান পৃথিবীর বায়ু থেকে আর নিঃশ্বাস নেবেন না। মানুষের দিকে তাকিয়ে বলবেন না, আপনাদের জীবনের কথাইতো লিখেছি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। এবার বিদায়। চির বিদায়ে চলে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন বিপুল সম্পদ। সাহিত্যের ভুবনে এই সম্পদ সাহিত্যপ্রেমী মানুষের তৃষ্ণা মেটাবে। পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে পাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়, সৃজনশীলতার গভীরতায়, গবেষণার চর্চায়। এভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃজনের সবটুকু পরিধি নিয়ে। বিষয়কে চিন্তা-চেতনায় শিল্পরূপ দেয়ার যে দক্ষতা থাকে সে জায়গাটিকে রিজিয়া রহমান গভীরভাবে আত্মস্থ করেন। লেখালেখির পুরো সময়ে তিনি সেই মগ্নতা থেকে নিজেকে সরাননি। তিনি আমাদের সাহিত্যকে উজ্জীবিত করেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে এর পরিসর বৃদ্ধি করেছেন। তাঁর ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের একটি অসাধারণ কাজ। ইতিহাসের পটভূমিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে জনজীবনের নির্মাণকে চমৎকারভাবে তুলে আনার উদাহরণ এই উপন্যাস। তাঁর আর একটি উপন্যাস ‘আবে রওয়াঁ’। উপমহাদেশে মসলিন বস্ত্রশিল্পের পটভূমিতে কাহিনী গড়ে উঠেছে, এই উপন্যাসের আলোচনা এখানে তুলে ধরছি। রিজিয়া রহমানের উপন্যাস ‘আবে রওয়াঁ’। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের পটভূমি মোগল শাসকদের রাজত্বকাল- ঢাকা শহরের পত্তন- মসলিন বস্ত্র এবং মসলিন তৈরির কারিগর ও কাটুনিরা। সঙ্গে আছে ফরাসি কুঠির সাহেবরা- তাদেরই একজন ফরাসি ব্যবসায়ী চার্ল, উপন্যাসের শুরুতে চন্দননগর থেকে জাহাজে করে ঢাকায় আসছে। উপন্যাস শেষ হয় ঝড়ে উড়িয়ে নেয়া কাটুনি সখিনাকে চার্লের উদ্ধার করার মধ্য দিয়ে। আবে রওয়াঁ মানে চলমান জল। কিন্তু এই নামের সঙ্গে যুক্ত হলো একটি মসলিন শাড়ির নাম। মসলিনের অসাধারণ কারিগর হাতেম এই নাম রাখার ঘটনা মেয়ে সখিনার কাছে এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘তুই আমাকে সুতা কাইটা দে। এমুন সুতা কাটবি, য্যান নজরে না আসে, হাওয়ার লগে ভাসে, পানিতে ডুবে না। সেই সুতায় তরে আমি বুইনা দিমু সেই আবে রওয়াঁ, যেই আবে রওয়াঁ বুইনা দিছিলাম সারা দুনিয়া আলো করা নূরজাহান পরীরে। যার নাম রাখলেন বেগম আবে রওয়াঁ।’ এরপরে মসলিন শাড়ির বর্ণনা মিশে গেল সে সময়ের লোকগীতে- জলেতে ভাসাইয়া দিলে জলে মিশা যায় আকাশে উড়াইয়া দিলে হাওয়ায় মিলায়... ... মসলিনের সুতা কাটানোর জন্য ভোরের আলো ফোটার আগে কাটুনিদের মেতে ওঠায় চৌকিদার, ‘ঘুমের মধ্যেই সখিনা শুনতে পায় চৌকিদারের হাঁক- ওঠ রে, কাটুনিরা ওঠ। রাইত পোহায়। জাগো রে, কাটুনিরা জাগো।’ কাটুনিরা জাগে, ওঠে। ক্ষোভ প্রকাশ করে, ‘নাসিব রে। টানার সুতা কাইট্যা চক্ষু খোয়াইতাছি, নিজে একখান আবরোরা, শবনম ফিন্দা দ্যাখলাম না।’ কাটুনিরা সুতা কাটে। মসলিন তৈরি হয়। সে মসলিন চলে যায় বাদশা-বেগমের অন্তঃপুরে। সখিনা মুখ ফসকে একটু-আধটু ক্ষোভের কথা বললেও, পর মুহূর্তে নিজেকে শাসন করে। কারণ ‘আলাবালি গ্রামের ছোট বাচ্চাটা পর্যন্ত জানে, কাটুনি মেয়েরা ঝগড়াঝাটি, গালাগালি করে না, দুঃখের কথা, আফসোসের কথা বলে না। বিলের পানির মতো তারা সুস্থির।’ তাদের তো সুস্থির থাকতে হয়। পণ্য তৈরির উপাদান হয়ে তারাও যে আরেক রকম পণ্য। যেমন পণ্য নবাবের ঘরের মেয়েরা। শাহী তখতের অনেক ফোঁকর বন্ধ করার জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্বশালী যুবতী পরী বিবিও এর বাইরে যেতে পারেনি। শাহী অন্দরমহলের নবাব-কন্যা পরী বিবির খাস বাঁদী, আসমানি, ‘খালা তাকে গোলাম-বাঁদীর হাটে বিক্রি করেছিল।’ সেই আসমানিকে পরী বিবি বলে, ‘শাহজাদা আযমের সঙ্গে আমার শাদি আসলে শাদি না, সতরঞ্জের খেলা।’ তাই পরী বিবি বিয়েতে রাজি নয়। এর অন্তরালে আছে মসলিন ব্যবসার অর্জিত মুনাফার লেনদেনের হিসাব। সেজন্য মহলের বয়স্ক বাঁদী গলা নামিয়ে আসমানিকে বলে, ‘নবাবের নবাবি তো হালাক হচ্ছিল, শেষে শাহজাদা আযমের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে কবুল হওয়ায় আপাতত রক্ষা হলো।’ আসমানির প্রশ্ন, ‘বিবি কি কবুল করবেন?’ আসমানির প্রশ্নের উত্তরে মুখ ঝামটা দেয় গোলাপ বাহার, ‘আরে, কবুল না করে যাবে কোথায়? শাদির রাজি-নারাজির চেয়ে সুবাদারির তখত অনেক বড়।’ এভাবে মেয়েরা বলি হয়, এভাবে মেয়েরা হাটে বিকোয়, রাজ-তখতের জন্যও তাদের বলিদান অনিবার্য হয়ে পড়ে। আবার বাঁদী আসমানির কাছে মসলিন আর রেশমের বস্ত্র খাঞ্জা বোঝাই হয়ে আসে। উৎসব পড়ে তাকে নবাবের তাঁবুতে যেতে হবে- এক রাতের জন্য তাকে নবাবের ভোগের সামগ্রী হতে হবে। ঔপন্যাসিক মসলিনের প্রেক্ষাপট এভাবে যোগ করেন নারীর জীবনের সঙ্গে। মসলিন সুতার কাটুনি হয়ে থাকা তাদের এক জীবনের সত্য- এটি একটি দিক। নবাবের যৌন-স্বেচ্ছাচারের সঙ্গী হলে মসলিন পরা যায়- এটি আরেকটি দিক। মসলিনের বাণিজ্যের জন্য মিনাবাজারের আয়োজন করে নবাবের মেয়েরা- এটি আরেকটি দিক। অন্য আরেকটি দিক মসলিন বিক্রির ব্যবস্থার হাত বদল- ‘শিকারি কাজের মতো সেগুলো তুলে নিয়ে গেল মলমলখানার দারোগার লোকেরা। বলল- তোমাদের দরকার নেই আর। এসব মসলিন শাহজাদার খাস লোকেরাই বিক্রি করবে। কাপড় বিক্রি হয়ে গেলে তারপর পাবে বাকি মজুরি।

বড় মাপের একজন কথাশিল্পী হয়েও থেকে গেছেন আলোর আড়ালে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির যে দ্যুতি, তাঁর গদ্যের যে শক্তি, সে শক্তি নিজের দীপ্তিতেই আলো ছড়াবে, যে আলোয় নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ পাবো আমরা। প্রশ্ন হলো, সে সুযোগ কাজে লাগাবার ঔদার্য আমাদের আছে তো? রিজিয়া রহমান-এর উপন্যাস পড়ার ধৈর্য এবং মানসিক সামর্থ্য আমাদের আছে তো?

শাহী শহরের দরজা আর একবার বন্ধ হয়ে গেল সখিনার জন্য।’ দিনমজুরি থেকে শুরু করে অর্থনীতির জমিন, যৌনতার খোলসে নারীর জিন্দা লাশ হয়ে যাওয়ার চিরায়ত দুঃসংবাদ, নবাবের অন্তঃপুরের ক্ষমতার রাজনীতিতে নারীর অবস্থান এবং বাণিজ্যে পরাজিত ভূলুণ্ঠিত নারীর দুর্গ- এ বইয়ে যতটুকু জায়গা নিয়েছে, তারচেয়ে বেশি দাবি করে। কিন্তু বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো আরো বিস্তৃত জায়গা পেল না কেন, আরো মর্মঘাতী হলো না কেন এ প্রশ্ন থেকে যায়। উপন্যাসের একটি অন্যরকম চরিত্র হাতেম আলী, যার কাছে জীবনের তিক্ততা পৌঁছে না। ভোরের আলো ফোটার আগে যেমন মসলিন বুননের কাজ শেষ করতে হয়- তেমনি হাতেম কারিগর মসলিন-জারিত সৌন্দর্যবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবন-অভীক্ষায় আশ্চর্য উদার। উপন্যাসের উনিশ পৃষ্ঠায় তার শুরুটা এমন : ‘চোখে একেবারেই আলো সহ্য হয় না, এককালের নামি মসলিনের কারিগর হাতেম আলী। সারা জীবন ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘরে বসে শবনম, আবে রওয়াঁ, কাশিদা আর মলমল খাস বুনতে বুনতে সূর্যের আলোর কথা ভুলেই গেছে সে। এখন সে মসলিন বোনে না।... আলাবালি গ্রামের সবাই জানে মসলিন বুনতে বুনতে এখন প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে সে। সারা দিন বসে থাকে অন্ধকার ঘরে।’ এই হাতেম আলী অনবরত বলে যায় মসলিনের গল্প। যেন এ তার আপন পৃথিবীর রূপকথা। সখিনা যখন মসলিন বিক্রির অধিকার হারায় তখন সে মেয়েকে সান্ত¡না দেয় অন্য কথা বলে, ‘কান্দস ক্যান রে সখিনা। অহন তো আর চিন্তা নাই। জমিদারের দেওয়ানের জরিমানা নাই, কাপড় বেইচ্যা দারোগা মজুরির ট্যাকা দিলে ভিটায় নতুন ঘর উঠামু আমরা। ...তুই আমারে সুতা কাইটা দে। এমুন সুতা কাটবি, য্যান নজরে না আসে, হাওয়ার লগে ভাসে, পানিতে ডুবে না। সেই সুতায় তরে আমি বুইনা দিমু সেই আবে রওয়াঁ, যেই আবে রওয়াঁ বুইনা দিচ্ছিলাম সারা দুনিয়া আলো করা নূরজাহান পরীরে।’ মেয়েকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে সে তাকে স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়। যে মসলিন পরার সামর্থ্য তার নেই তার জন্য মসলিন বুনতে চায় হাতেম আলী। ওই চরিত্র মসলিনের পুরো আবহকে পাঠকের সামনে ভিন্ন রূপ দেয়। যে রূপ ধরে মসলিন আজো এ দেশের মানুষের কাছে এক অলীক বস্ত্র। তাকে নিয়ে যত কল্পকথা রচিত হয়েছে অন্য কোনো শাড়ি নিয়ে তা হয়নি। হাতেম আলীর চরিত্র একটি সময় ও একটি পোশাককে ধরে রাখে। পাঠক তার কারণে এই ইতিহাসখ্যাত শাড়ির কারিগরের আবেগ অনুভব করে। কিন্তু সমাজের বড় প্রেক্ষাপট তার আবেগে অনুপস্থিত। এই উপন্যাসে কাটুনি সখিনার শেষ পর্যন্ত মসলিন শাড়ি পরা হয়। ওকে ঝড়ে উড়িয়ে নেয়ার সময় হাতে ছিল আবে রওয়াঁ শাড়ি। ফরাসি বণিক চার্ল যখন তাকে নদীর চর থেকে উদ্ধার করে তখন ও পরে ছিল ওই শাড়ি। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে সে তার শরীরে ভেজা মহার্ঘ বস্ত্রটি খুলে চার্লের হাতে দিল। দৃষ্টি নামিয়ে খুব আস্তে বলল, ‘আমি সখিনা। এই কাপড় আমার। এর নাম আবে রওয়াঁ।’ কাটুনি সকিনা অনায়াসে বিদেশি বণিকের হাতে তুলে দেয় নিজের দেশীয় বস্ত্র। বাংলার গণমানুষ তার বস্ত্রের ওপর থেকে অধিকার হারায়। তার অবস্থান দাঁড়ায় দিনমজুরের। এই নিয়তই ছিল সে সময়ের মানুষের জীবনের সত্য। তারপরও সামাজিক-সংঘাত, বাণিজ্যিক-সংঘাত, দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের চোরা গলিঘুপচি ডিটেইলসের আধার বিস্তৃতি পায়নি উপন্যাসে। উপন্যাসের বড় ধরনের শিল্প-তাৎপর্য মিসিং থাকে। ঔপন্যাসিক শুরু এবং শেষে বুড়িগঙ্গা নদীকে একটি চরিত্রের মাত্রা দিয়েছেন। এই নদীও উপন্যাসের গাঁথুনিকে শক্ত করেনি, নেহাতই গল্পের সূত্রধর মাত্র। তারপরও বিষয়ের নতুনত্বে ‘আবে রওয়াঁ’ পাঠকের তৃষ্ণার জল। রিজিয়া রহমানকে পৌঁছাতে হবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে। তাঁর সাহিত্য নিয়ে গবেষণা হবে। শিক্ষার্থীরা তাঁর সাহিত্য আলোচনায় এনে অন্যদের জানাবে শেকড়ের মূল। জানাবে নিজ জাতিসত্তার দিগন্তবিহারী চেতনার ফসলের মাঠ। বাংলা-বাঙালির জাতিগত দর্শনের সৌরভ। তরুণ প্রজন্ম পাঠে-গবেষণায় রিজিয়া রহমানের সাহিত্যের ভিন্ন পরিসর তৈরি করুক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App