×

সাময়িকী

যিনি সকলের স্যার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২০, ০৬:৩৫ পিএম

যিনি সকলের স্যার
   

সকল পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে তো বটেই- এমনকি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলে নিজেদের আবদ্ধ-সমর্পণ করেছেন, পার্থিব স্বার্থের টানে। শাসকশ্রেণির প্রধান দলে সকল পেশাজীবীর ন্যায় বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, নীতি, নৈতিকতাকে বন্ধক দিয়ে ফেলেছেন। সকল বিবেচনায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দৃষ্টান্তে অনন্য। সারাটি জীবন রেললাইনের পথের ন্যায় একই ছন্দে লাইন ধরে চলেছেন। কখনো লাইন চ্যুত হননি।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সকলেরই তিনি স্যার। তাঁকে সবাই স্যার বলেই সম্বোধন করেন। সমসাময়িকদের কাছে সিরাজ সাহেব। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছিলাম সাংবাদিক-সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ, যিনি স্যারকে নাম ধরে এবং তুমি সম্বোধনে ডাকতেন। ফয়েজ ভাইয়ের ন্যায় হয়তো অনেকে ছিলেন কিন্তু আমার দেখা কেবল ফয়েজ ভাইকেই। পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় শিক্ষক। সত্য এই যে, স্যারের শিক্ষার্থী কেবল ইংরেজি বিভাগে সীমাবদ্ধ কখনো ছিল না। স্যারের সীমা দেশ-বিদেশ জুড়ে বিস্তৃত। তাঁকে আড়ালে সবাই ঝরপ ঝরৎ বলে সম্বোধন করেন। ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে ইমেরিটাস অধ্যাপক। স্যারের প্রখর চিন্তাশীল লেখার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রবন্ধ সাহিত্যের ন্যায় বিরস সাহিত্যও যে জনপ্রিয় সুখপাঠ্য হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্যারের অসামান্য রচনাসমূহ। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশত। তাঁর বিশ্লেষণ-গবেষণা সমৃদ্ধ প্রবন্ধে সাহিত্যের উপাদান প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তাঁর গ্রন্থ পাঠে পাঠক কেবল জ্ঞানে ঋদ্ধ নয়, অসাম্য-অনাচারের বিদ্যমান ব্যবস্থা ভাঙার অনুপ্রেরণাও লাভ করে। তাঁর প্রতিটি রচনায় পাওয়া যায় ব্যবস্থা বদলের পথের দিশা। ইতিহাস, সমাজ, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, দেশি-বিদেশি সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনোটির অনুপস্থিতি নেই। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যন্ত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করে-ঘৃণিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পথও অকপটে প্রকাশ করে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা, বক্তব্য, লেখনীতে সমাজ বিপ্লবের আকাক্সক্ষা এবং পথটির নির্দেশনা দিতে ভুল করেন না। আমাদের সমাজে জ্ঞানী-পণ্ডিতের অভাব নেই। পণ্ডিত ব্যক্তি নিশ্চয় আছেন। তবে মতাদর্শে অবিচল দ্বিতীয়জনকে খুঁজে পেতে কষ্টই হবে। তাঁর রচিত প্রবন্ধে নিখুঁত চুলচেরা বিশ্লেষণে পাঠকের মনোজগৎকে কেবল বিকশিত নয়, শাণিতও করে। সে কারণে স্যারের পাঠকের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। তাঁর রচনা পাঠে পাঠকমাত্রই শিক্ষার্থী হয়ে পড়ে। পাঠককে পাঠে উদ্বুদ্ধ-আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে স্যারের লেখনীয় মুন্সীয়ানাকেও অস্বীকার করা যাবে না। প্রবন্ধ সাহিত্যকে হৃদয়গ্রাহী করার অভিনব সৃষ্টিশীল মাত্রা তিনি যুক্ত করেছেন, তাঁর প্রবন্ধসমূহে। তিনি যে সকলের স্যার, তার প্রধানতম কারণটি তাঁর নীতিতে অবিচল এই সুদীর্ঘ পথযাত্রা। যেখানে আত্মসমর্পণের একটি দৃষ্টান্তও নেই। সঙ্গত কারণেই তাঁর পরিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ অতীতেও ছিল না। আজও নেই। কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুদীর্ঘকাল আদর্শে অবিচল থাকার নজির আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই। আদর্শে অবিচল ব্যক্তির আকাল চলছে দেশজুড়ে। স্যারের ন্যায় মতাদর্শে অবিচল ব্যক্তি আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ। পার্থিব প্রলোভন, লোভ-লালসা এড়িয়ে চলা এক অনন্য দৃষ্টান্ত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৮১-তে ক’বছরের জন্য আমি বিদেশে ছিলাম। তবে নাজমা আপার সঙ্গে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ ছিল। স্যারও নিজের বই প্রকাশিত হলে আমাকে পাঠাতেন। এক চিঠিতে নাজমা আপা জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী স্যারকে উপাচার্য পদে নিয়োগের জেনারেল এরশাদের প্রস্তাব তাঁরই সম্মুখে স্যারের প্রত্যাখ্যান করার সংবাদ। চিঠিতে আরো লিখেছিলেন, ‘তোমাদের স্যার ভাগ্যিস ভিসি হতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি। ভিসি হবে হবে ঐসময়ে আমাদের চারপাশে সুযোগ সন্ধানী-সুবিধাবাদী অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমরা আমাদের প্রকৃত বন্ধুদের হারাতে বসেছিলাম। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।’ ব্যক্তিগতভাবে জানি দ্বিতীয়বার তাঁকে উপাচার্যের পদ গ্রহণের প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভিসি পদটি শতভাগ রাজনৈতিক। আত্মসমর্পণে পারদর্শীদের জন্যই ঐ পদ মানায়, নীতিনিষ্ঠদের নয়। ঐ পদ দলীয় আনুগত্যের প্রতীকে পরিণত। আমাদের ক্ষমতাসীন শাসকদলের লেজুড়বৃত্তিতে পারদর্শীদেরই আনুগত্যের পুরস্কারস্বরূপ ঐ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই ঘৃণিত বিরাজমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্যারের প্রত্যাখ্যান ছিল অনন্য দৃষ্টান্ত। মনে পড়ে, আমার উপস্থিতিতে জেনারেল জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ নিয়ে স্যারের বাসায় সস্ত্রীক এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান প্রয়াত মাহফুজুর রহমান। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব শোনামাত্র স্যারের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখের সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রিত্বের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বুকের ওপর হঠাৎ চেপে বসা পাথরটি অপসারণে যেন মুক্তিলাভ করলেন। স্যারের পিতা চেয়েছিলেন মেধাবী বড় ছেলেটি সিএসপি হোক। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলে অভিভাবক এবং মেধাবী ছাত্রদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শাসক সহযোগী আমলা হওয়া। সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিতে মেধাবীদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। সেই অভিলাষে স্যারের পিতা স্যারের হাতে সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফরম তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার সেই ফরমটি ছিঁড়ে শাসক সহযোগী আমলা হবার সনাতনী প্রতিষ্ঠার বিপরীতে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছিলেন। যাতে মেরুদণ্ড সোজা রেখে জীবনভর চলতে পারেন। পিতার সম্মুখে যে অসম দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছিলেন, সেই সুকঠিন দৃঢ়তায় এ পর্যন্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখেই চলছেন। আত্মসমপর্ণের একটি দৃষ্টান্ত তাঁর চরম শত্রুও দিতে পারবে না। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন একজন সফল, দক্ষ, জনপ্রিয় শিক্ষক রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের নানা লোভনীয় প্রস্তাব সযত্নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষাকে বাণিজ্যকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁর নীতিগত অবস্থান, এসকল অসংখ্য প্রলোভনেও তাঁকে টলানো সম্ভব হয়নি। বিগত আঠারো বছর ধরে স্যারের সম্পাদনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অতিমাত্রায় পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, সচেতন সম্পাদকরূপে তাঁকে দেখে আসছি। পত্রিকায় একটি শব্দও তাঁর চোখ এড়িয়ে প্রকাশের উপায় নেই। পত্রিকাজুড়ে তাঁর পরিশ্রমী নিপুণ সম্পাদনায় পত্রিকার এই দীর্ঘ পথচলা সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকট চেহারা আমরা নিত্য দেখে থাকি। সকল পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে তো বটেই- এমনকি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলে নিজেদের আবদ্ধ-সমর্পণ করেছেন, পার্থিব স্বার্থের টানে। শাসকশ্রেণির প্রধান দলে সকল পেশাজীবীদের ন্যায় বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, নীতি, নৈতিকতাকে বন্ধক দিয়ে ফেলেছেন। সকল বিবেচনায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দৃষ্টান্তে অনন্য। সারাটি জীবন রেললাইনের পথের ন্যায় একই ছন্দে লাইন ধরে চলেছেন। কখনো লাইন চ্যুত হননি। মতাদর্শে অবিচল সকলের পরম শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রিয় মানুষ,গত ২৩ জুন স্যারের ৮৪তম জন্মদিন ছিলো। জন্মদিনে জানাই অভিনন্দন, বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App