আমার কাছে ঈদ পুজো দুটোই সমান

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৭:২৭ পিএম

আমার এখন চুয়াত্তর বছর বয়স। কিন্তু শৈশবের সেই ঈদের স্মৃতি এখনও অমলিন। আমার ছেলেবেলার ঈদ ছিল খুবই চমৎকার। অন্যরকম রঙিন। তখন ঈদের আনন্দটাই ছিল আলাদা। নতুন জামা পাওয়া, জর্দা সেমাই ইত্যাদি খাওয়া। বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বাবার হাত ধরে ঈদগাঁয় যাওয়া। শৈশবে এসব করেছি অনেক। বড়ো হওয়ার পর ঈদগাঁয় যাওয়া আর হয়নি। নতুন জামা পড়ে খাওয়া-দাওয়া, সবার সঙ্গে মিলেমিশে হৈ-চৈ করা তখন ছিল একটা বড় দিক। সেই সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিটাও খুব ভালো ছিল। এই সময়ের মতো এতো তীব্র ছিল না। আমার কাছে ঈদ এবং পুজোর উৎসব দুটোই সমান। সেইসময় বাবার হাত ধরেই ঈদের ময়দানে যাওয়া, বাবার পাশে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা, পুজোর যখন প্রতিমা বানানো হতো তখন ওই প্রতিমা দেখার জন্য ছুটে যাওয়া, পূজামণ্ডপের সামনে গিয়ে আমাদের মানুষরা কিভাবে প্রতিমা বানাচ্ছে সেইটাও দেখা, এর সবকিছুর সমন্বয়ে আমার শৈশবটা বর্ণিল এবং একটা বড় জায়গা নিয়ে স্মৃতিজুড়ে আছে। আমার জীবনে ঈদ পুজো দুটোই ছিল আনন্দের। ঈদ পুজো দুটোই আমার কাছে সমান।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার মনে হয়েছিল যে, এটা শৈশবের স্মৃতির উৎসব নয়। এটার দায়ও আছে। কারণ যখন দুই ঈদের সামনের জায়গায় চিন্তা করি, আমার কাছে ঈদটা আর স্মৃতি থাকে না। তখন সামাজিক দায়বোধের জায়গা থেকে চারপাশ দেখি। এখন ধর্মীয় উৎসবের বিচার বিশ্লেষণ বৈষম্য ধরা পড়ে কোরবানির ঈদে। যেমন ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। পরেরটি আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন, এই শিক্ষা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। এই আয়োজনে এখন কে কতো বিশাল দামের গরু কিনতে পারল সেটাই একটা বিশাল প্রতিযোগিতার ব্যাপার হয়ে গেছে। যে কারণে কোরবানিটা করা হয়, সেই শিক্ষার জায়গাটা এখন এখানে নাই। এখানে আমরা ধনীদের মধ্যেই দেখি, কে কত দামে গরুটা কিনল। সেইটারই শো-অফ করার জন্য তাদের একটা লক্ষ্য থাকে। কিছু মাংস প্রতিবেশীকে দিয়ে বেশিরভাগ মাংস ডিপ ফ্রিজে বোঝাই করে রেখে সারা বছর খায়। এটাই এখন ঈদের প্রধান লক্ষ্য। গণমানুষকে দেয়ার চিন্তা ওভাবে থাকে না তাদের।
করোনাকালের এই ঈদে মহামারি ও মৃত্যু ‘ম’ দিয়ে দুটো শব্দ বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনকে ধ্বংস করছে। এটাও একটা বড় দিক। বাংলাদেশেও মুষ্টিমেয় অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত। যেসব পরিবার তাদের স্বজনরা হারিয়েছেন সেইসব পরিবারের মানুষের কান্না, যারা স্বজন হারাননি, কিন্তু চারপাশের মানুষের আর্তনাদ তাদের কাছেও একটা কষ্টের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নিরন্ন মানুষের হাহাকার। তাদের কাজের পরিধি নাই। হাতে টাকাপয়সা নাই। অনেক সময় পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই, ওরা বলে, ‘এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছি’। এইসব পরিস্থিতিতে ঈদের উৎসব শব্দটাও ব্যবহার করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। এই শব্দটা আমি বলব না। এই বছর ঈদ আমাদের জন্য কোনো উৎসব নয়। শুধুই বেদনার।
অবশ্য এখন অনেককে দেখছি দিব্যি পশুর হাটে নিঃশঙ্ক চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে বড্ড অবাক হচ্ছি। ব্যক্তি যদি তার বোধটাকে ঠিক না রাখে, তাহলে তো সেটা ব্যক্তির দায়ের মধ্যে পড়ে যায়। সবসময় আমরা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবো, নিজেদের চেতনা, নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ে চিন্তা আমাদের মাঝে থাকবে না। এমন কেন হবে? এখন পুলিশ এসে আমাকে বলবে কোথাও যেতে পারবেন না, ঘরে থাকেন, আর আমি গিয়ে হৈ হৈ শুরু করলাম! এটা তো উচিত নয়। আমার বিষয়টা আমার নিজের চেতনা থেকেই বুঝতে হবে। নিজের ভালো মন্দ বোধ থেকে জানতে হবে। এই বিষয়গুলোকে আমি এইভাবেই দেখতে চাই যে, ব্যক্তির চেতনাবোধ যেন অনেক বেশি গাঢ় হয়। সে যেন তার নিজের জীবন রক্ষার জন্য সমুদয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কারণ আমাদের এখানে এটার সঙ্গে শিক্ষার তেমন যোগ আছে বলেও আমি মনে করি না। এটা সম্পূর্ণই চেতনাবোধের জায়গা। এই জায়গা থেকে আমাদের সব কিছু শিখতে হবে এবং নিজের মতো করে আমরা যেন সেই জায়গাটাকে ধারণ করতে পারি। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের জন্য কী করল বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের জন্য কী করল, এটা বলার জন্য তো একটা বড় জায়গা আছেই। আমরা তাদের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশাও করি। তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন আমাদের অনেক কিছু। কিন্তু নিজের বোধটাকেও কাজে লাগাতে বলি সব মানুষকে। যারা আজকের দিনে করোনা সম্পর্কে সচেতনভাবে বিষয়টাকে ধারণ করতে পারতেন।