হঠাৎ আলোচনায় কিংস পার্টি

ঝর্ণা মনি
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি : ভোরের কাগজ
বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে। সরকার সমর্থক কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার মুখে হঠাৎই আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে ‘কিংস পার্টি’। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল গঠন করার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে আলোচনার সূত্রপাত হয়। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বাম রাজনৈতিক দলগুলো। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠিত হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি। আর ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় কিংস পার্টির ফলাফল কখনোই ভালো হয় না বলে মন্তব্য বাম রাজনীতিবিদদের।
জানা গেছে, আসন্ন জানুয়ারি মাসে জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক দলটি আত্মপ্রকাশ করবে। যদিও গত শনিবার এক বিবৃতিতে দলের নাম নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি বলে দাবি করেছে কমিটি। তবে সূত্রমতে, ‘জনশক্তি’ নামেই আত্মপ্রকাশ করবে নতুন এই দল। দলটি ‘মডার্ন ইসলামিক’ ধারার হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিøষ্টরা। দলকে সারাদেশের জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আগামী নির্বাচন উপলক্ষে সৃষ্টি হওয়া এই দলের লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া নয়; বরং টার্গেট থাকবে বিপুল পরিমাণ জনসম্পৃক্ততা ঘটিয়ে বিরোধী দলে থাকা। এ নিয়ে নানা হিসেব-নিকেষ কষছে তারা। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির দলছুট কর্মীদের টার্গেট করে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আপাতত. জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চলার কৌশল নিয়েই এগুচ্ছে দল গোছানোর কাজ।
এদিকে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর এক থেকে দুই মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে একটি সুন্দর রাজনৈতিক দল উপহার দেবে। শনিবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাগরিক কমিটির ‘জনশক্তি’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। সন্ধ্যায় কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে রাজনৈতিক দলের কোনো নাম কিংবা সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়নি। এতে আরো বলা হয়, ‘বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাতে প্রকাশিত সংবাদ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে অনাগত
রাজনৈতিক দলের নাম ‘জনশক্তি’; যা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।’
এদিকে প্রায় চার মাস সময় পার হলেও নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা। অন্যদিকে বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ২০২৫ সালের শেষদিকে কিংবা ২০২৬ সালের প্রধমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকার যখন ব্যস্ত; তখন কিংস পার্টি গঠন করার চিন্তা কতটা ইতিবাচক- এমন প্রশ্ন তুলেছেন রাজনীতিকরা। বিএনপির মতে, ছোট ছোট কিংস পার্টি- যাদের নির্বাচনে জেতার ক্ষমতা নেই; তাদের দিয়ে সরকার অসাংবিধানিক একটি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করছে। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট : উচ্চকক্ষের গঠন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে থাকাদের থেকে নতুন রাজনৈতিক দল খোলার আগ্রহ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে তিনি দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে বলা হচ্ছে, নতুন দল তৈরি করতে হবে। নতুন দল তৈরি করার কথা বললে জনগণ কীভাবে বুঝবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন? বিএনপি মহাসচিব বলেন, যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, এই সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যখন বলেন, নতুন দল তৈরি করতে হবে, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। যদি বলেন, নতুন দল তৈরি করতে হবে, তাহলে জনগণ কী করে বুঝবে- তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন?
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাজনৈতিক দল করার অধিকার সবার আছে। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশীজনদের গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে হবে। তিনি বলেন, স্বৈরাচারের প্রভাবে নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি ও সব অপরাধী একত্র হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে, কোনো দলকে সংগঠিত করলে তা অপরাধীদের দল হবে। বাংলাদেশের জনগণ যথেষ্ট সচেতন। তারা উটপাখির মতো বালুর নিচে মাথা গুঁজে নেই। এদিকে, শনিবার থেকে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। ওই বৈঠকেও কিংস পার্টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে- এক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাবই উঠে এসেছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
চার মাসে ৫ দল : ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছিলেন, তারা একটি নতুন ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চান, সেটি রাজনৈতিক নতুন দল গঠনের পথে এগিয়ে যাবে কিনা, তা পরে ঠিক হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি রয়েছেন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তরুণদের নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে যাচ্ছেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে চার মাসে ৫ রাজনৈতিক দল ও একটি জোটের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগস্ট বিপ্লবে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতার একাংশের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের ৭৭ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে নতুন দল জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। এদিন দোয়া মাহফিল শেষে সংগঠনটি শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে মিছিলসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করে। কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আনিসুর রহমানকে রাজনৈতিক প্রধান, মোহাম্মদ শাফিউর রহমানকে সাংগঠনিক প্রধান ও খোমেনী ইহসানকে আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হাসান মোহাম্মদ আরিফকে সদস্য সচিব মনোনীত করা হয়েছে। এছাড়া কমিটিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নারী, গবেষক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দায়িত্বের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক, আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব ও সামান্তা শারমিনকে মুখপাত্র করে ৫৫ সদস্যের জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে গত ৮ সেপ্টেম্বর। এরপর থানা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি কমিটি করার কাজ শুরু করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এলেও অক্টোবরে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে সাংগঠনিক রূপ নেয়। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জেলা পর্যায়ে সফরের সফরের পর এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তখনই তাদের নেতৃত্বে দল গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
১৫ নভেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টির (বিআরপি)। অনুষ্ঠানে ৭১ সদস্যবিশিষ্ট নবগঠিত দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক হয়েছেন লন্ডন প্রবাসী মো. সোহেল রানা। একই দিনে রাজধানীর শিশু কল্যাণ পরিষদে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করাসহ ২২ দফা প্রস্তাবনা নিয়ে বিপ্লবী গণজোট নামে আত্মপ্রকাশ করেছে ৫টি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। জোটে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ গ্রিন পার্টি, বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টি, বিপ্লবী গরীব পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, পীস ফোরাম ও প্রয়াত নেতা স্মৃতি সংসদ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’ (বিপিপি)। গত ৮ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি’র। দলটির চেয়ারম্যান এস এম শাহাদাত নতুন এই দলের ঘোষণা দেন।
তরুণদের সম্ভাবনা নষ্ট করবে : রাজনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার সবার রয়েছে। একজন নাগরিক হিসেবে যে কোনো সময়ই সংগঠন করার অধিকার তার রয়েছে। তবে ‘কিংস পার্টি’ বা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এসব রাজার দল নির্বাচনের আগে কিছুদিনের জন্য রাজনীতিতে আলোচনার খোরাক হলেও এক সময়ের ডাকসাইডে রাজনীতিকরা পরে দলছুট হয়ে পুতুলে পরিণত হন। এমন পরিণতি ব্যক্তি, দল, সমাজ বা রাষ্ট্র কারো জন্যই সুখকর বার্তা বয়ে আনে না। জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ভোরের কাগজকে বলেন, রাজনৈতিক দল গঠন এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা নাগরিক অধিকার। তবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় কিংস পার্টির ফলাফল কখনোই ভালো হয় না, হবেও না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে ছাত্র-তরুণদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। সরকারও নানা দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।