প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ‘লজ্জাবতী’ গাছ

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) থেকে
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম

ফাইল ছবি
হাত দিয়ে ছুঁলেই নুইয়ে পড়ে লজ্জায়। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় অনেক বেশি স্পর্শকাতর এই উদ্ভিদ, নাম লজ্জাবতী। একসময় সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলাসহ হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তার পাশে ও ঝোপঝাড়ে যত্রতত্র এ উদ্ভিদ দেখা গেলেও এখন আর চোখে পড়ে না। স্থানীয়দের মতে, সংরক্ষণের অভাবে এখন গ্রামীণ প্রকৃতি থেকে হারাতে বসেছে এই কাঁটাযুক্ত ভেষজ উদ্ভিদটি ।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের মতে, লজ্জাবতীর নাম 'মিমোসা পুডিকা'। এর পাতা শুধু মানুষের স্পর্শেই নয়, তাপের প্রভাবে বা সন্ধ্যা বেলাতেও বন্ধ হয়ে যায়। মূলত সিসমোন্যাস্টিক চলনের প্রভাবেই এর পাতা বন্ধ হয়ে যায়। থোকায় থোকায় ফুল ফোটে। এর ফলগুলো চ্যাপ্টা, বাঁকা-লম্বাটে, ৮-১৩ সেন্টিমিটার, এতে ৪-১০ টি বীজ থাকে। পরিপক্ব ফল কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত হয়, প্রতি খণ্ডে ১টি করে বীজ থাকে। জুন থেকে ফুল ফোটা শুরু হয়ে শেষ হয় অক্টোবর মাসে। লজ্জাবতীর আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে। এ দেশে সাধারণত দুই প্রকারের লজ্জাবতী উদ্ভিদ দেখা গেছে। এর একটি লাল অপরটি সাদা। তবে উভয় প্রকার লজ্জাবতী উদ্ভিদেরই রয়েছে ভেষজ গুণ।
স্থানীয় কয়েকজন ইউনানি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লজ্জাবতীর ঔষধি গুণাগুণ অত্যন্ত বেশি। হারবাল ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। যেমন কফ দূর করতে, নাক ও কান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করতে, ডায়রিয়া, যেকোনো প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, আলসার, কুষ্ঠ কিংবা যোনি রোগ থেকে মুক্তি পেতে লজ্জাবতী উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়। শ্বাসকষ্ট, আলসার, অর্শ্ব বা পাইলস, পেট ফাঁপা, বদহজম ও যেকোনো ক্ষত সারাতে এ উদ্ভিদের রস ভীষণ কাজে দেয়। ঘামের দুর্গন্ধ দূর করতে লজ্জাবতী উদ্ভিদের ডাঁটা ও পাতার ক্বাথ তৈরি করে বগল ও শরীরে ব্যবহার করলে এই রকম সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। লজ্জাবতীর মূল থেঁতো করে সিদ্ধ করে পানি ছেঁকে এই পানি পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যাও দূর হয়।
আরো পড়ুন: রামগড় স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে যাত্রী পারাপার শুরু ১৪ আগষ্ট
লজ্জাবতী উদ্ভিদ নিয়ে কথা হয় স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক কাজল কুমার রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমাদের মা-চাচিরা তাদের সন্তানদের পেট খারাপ হলে, আমাশা হলে লজ্জাবতী গাছের পাতার রস খাইয়ে দিতেন। এতে এ রোগ ভালো হয়ে যেত। কাশি হলেও এ পাতার রস খাওয়ালে কাশি ভালো হয়ে যেত। এখন আধুনিক যুগে অনেক নতুন নতুন ওষুধ বের হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লজ্জাবতীর গুণাগুণ এখনও আগের মতোই আছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে আগের মতো এখন আর এ গাছ সচরাচর চোখে পড়ে না।'
যাদের দাঁত ও মাড়িতে ক্ষত আছে তারা ২০ সেন্টিমিটার লম্বা লজ্জাবতী গাছের মূল পরিষ্কার করে পানিতে ১৫ মিনিট সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে কুলকুচি করতে পারেন। নিয়মিত এ অভ্যাসেই ম্যাজিকের মতো দাঁত ও মাড়ির ক্ষত নিমেষে দূর হবে বলে জানিয়েছেন মধ্যনগর উপজেলার রংচী গ্রামের বাসিন্দা দন্ত চিকিৎসক আহমদ আলী।
মধ্যনগর উপজেলায় কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই। পার্শ্ববর্তী নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়ুর্বেদিক মেডিকেল অফিসার ডা. আবদুল ওয়াদুদ শিকদার বলেন, হাজার বছর ধরে লজ্জাবতী উদ্ভিদটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ভেষজ ওষুধ তৈরিতে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখনো এই উদ্ভিদের প্রয়োজন অপরিসীম। নানা রকম রোগ প্রতিরোধে কাজ করে এই লজ্জাবতী। মানব দেহের জন্য অনেক কার্যকরী এই ঔষধি উদ্ভিদ।
তিনি আরো বলেন, 'দূর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেষজ বাগানে এই ঔষধি উদ্ভিদটি নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা আছে। আমি মনে করি যার যার অবস্থানে থেকে ঔষধি গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।'