সামাজিক মাধ্যমগুলো যেন অপতথ্য-গুজবের কারখানা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
একটি পাকা বাড়ির আঙ্গিনায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো সারি সারি লাশ- এমন একটি ছবি গত কয়েকদিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ক্যাপশনে লেখা- ‘এ ছবি ফিলিস্তিন গাজার ভাবলে আপনি ১০০ শতাংশ ভুল ভাবছেন। এটা আমার প্রিয় মাতৃভূমির বর্তমান চিত্র’।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই ভাইরাল হওয়া আরেকটি ফেসবুক পোস্টে লেখা হয়, ‘২৭ জন নারীকে রোকেয়া হলের পেছনে নিয়ে গেছে ইজ্জত হরণ করতে। যারা কাছেই আছেন ওখানে গিয়ে বোনদের সাহায্য করেন।’ এই পোস্টটি ‘বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রিপারেশন’ ‘রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প ও গল্পের লিংক’, ‘এইচএসচি ব্যাচ ২০২৪’ নামে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে শেয়ার হতে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও এটি শেয়ার হয়।
উপরের প্রথম ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী পারফরম্যান্সের একটি ছবি চলমান সহিংসতার খুন হওয়া চিত্র বলে ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার নামে একটি ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান। তাদের অনুসন্ধানে বলা হয়, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল কিংবা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়- কোথাও ২৭ জন নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণচেষ্টার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি; বরং কোনোরকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়। একই সময়ে কুপিয়ে হত্যা করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নৃশংসতা হিসেবে এটি প্রচার করা হয়। কিন্তু ভিডিওটি ছিল ২০২১ সালে সন্ত্রাসী কর্তৃক এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে মারার দৃশ্য। সেটিকে সাম্প্রতিক ফুটেজ দাবি করে প্রচার করা হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে এভাবে খুন-ধর্ষণের মতো গুজব পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের উসকানি দিতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কেও মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ছবি বিকৃত করে শিক্ষার্থীদের উসকানি দেয়া হয় নাশকতার জন্য। শিক্ষার্থীদের উসকানি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য বিকৃতি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় ‘রাজাকার’ সেøাগান। রিউমর স্ক্যানারের তথ্য মতে, শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অন্তত ৩০টি গুজব ভয়াবহ ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে।
এর আগে গত কয়েক বছর ধরেই দেশজুড়ে ঘটেছে বেশ কিছু নাশকতার ঘটনা। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে হত্যা ও নাশকতার ঘটনাই শেষ নয়। কক্সবাজারের রামুতে ফেসবুকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনের নামে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে চালানো হয় বর্বরতা। ইন্টারনেটের অপপ্রয়োগের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বহু প্রগতিশীল ব্যক্তিকে হত্যা ও হামলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়। হামলা ও আগুন দেয়া হয় বহু অঞ্চলের মন্দিরে।
ইন্টারনেটের অপপ্রয়োগ করে গুজব ছড়িয়ে নাশকতা সৃষ্টিতে সক্রিয় রয়েছে জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ, টেলিগ্রাম চ্যানেলসহ এনক্রিপটেড বিভিন্ন অ্যাপস। আছে শত শত অনলাইন, যার কাজই হচ্ছে অপপ্রচার চালিয়ে নাশকতায় উসকানি দেয়া। দেশে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডও চলে এই পথেই।
বছরের পর বছর ধরে এরা সক্রিয় থাকলেও সরকার এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে খুব কম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যকর নেই ভালো কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তুলনায় উগ্রবাদীরাই এক্ষেত্রে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফলে এ শক্তির লাগাম টানতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও এর কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান সংকটে গুজব এখনো থামেনি বরং ডালপালা ছড়াচ্ছে। ইন্টারনেট গতি সীমিত থাকলেও ফেসবুকসহ ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ, টেলিগ্রাম গ্রুপ, হোয়াটআপ এবং একাধিক মাধ্যমে গুজব ও উসকানি ছড়ানো হচ্ছে। যেসব গ্রুপের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সেসব গ্রুপ গুজবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পেজ থেকেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করে প্রতিদিন কর্মসূচি ঘোষণা করছে একাধিক ব্যক্তি ও পেজ। সবশেষ গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, সায়েন্সল্যাবসহ সাতটি স্পটে শিক্ষার্থীদের নামার ঘোষণা দেয়া হয়েছে কয়েকটি গ্রুপ ও পেজ থেকে। এতে সাড়া দেয়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িতরা। ধানমন্ডি, পুরানা পল্টন ও মিরপুরে হাতেগোনা কয়েকজন রাস্তায় নেমে ধরা পড়েছে পুলিশের জালে। পুলিশ বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতাকে পুঁজি করে একাধিক চক্র ওই ধরনের আইডি খুলে সেগুলোতে উসকানিমূলক প্রচারণা ও কথিত কর্মসূচি প্রচার করছে, যা আগুনে ঘি দেয়ার মতো। সরকারবিরোধী চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছে অপপ্রচারের কাজে। যাচাই বাছাই না করে বা না বুঝে এগুলো শেয়ার দেয়া হচ্ছে। এভাবে বিস্তৃতি ঘটছে গুজবের।
সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ এস এম আসিফ বিন ইউসুফ ভোরের কাগজকে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার বা বিভিন্ন মিডিয়ার কন্টেন্টের একটি বড় অংশ হলো এনক্রিপটেড। গুজব ছড়াতে শিবির ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর শত শত ফেসবুক পেজ রয়েছে। এসব কাজে তারা খুব প্রশিক্ষিত। গুজব জাতীয় কন্টেন্ট ফিল্টারিং করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য এবং ব্যয়বহুলও বটে। তবে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকার যৌথভাবে কাজ করলে অনাকাক্সিক্ষত কনটেন্ট মুছে ফেলা সহজ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। গুজবের বিরুদ্ধে মিসরের নেয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গুজব প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপের বাইরে মিসর একটি কাজ করেছে। দেশটি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম্যে গুজব ঠেকাতে সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করে। গুজব প্রত্যাখ্যান করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় বেসরকারি টেলিভিশন ও পত্রিকায়। প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি যা দেখবেন, তার সবটাই বিশ্বাস করবেন না। সামাজিক নেটওয়ার্কে কোনো খবর শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করে নিন। খবর জানার জন্য বিশ্বাসযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য মাধ্যমের ওপর নির্ভর করুন। মিসরের মতো এমন পদক্ষেপও সরকার নিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের পুলিশ সুপার (এসপি) ইনামুল হক সাগর ভোরের কাগজকে বলেন, গুজব প্রতিরোধে পুলিশের সাইবার টিম সক্রিয় আছে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। গুজব বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে আমরা দ্রুত তার ব্যবস্থা নিচ্ছি।