তারুণ্যের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের নির্মাণ চাই

নাফিসা নাজীন লুৎফা
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫১ পিএম

তারুণ্যের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের নির্মাণ চাই
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা অসাধারণ সাহসিকতা ও দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে, তা শুধু দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পরিবর্তনে সহায়ক হয়নি, বরং একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের এই সংগ্রাম ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা দেশের গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের মত মুহূর্ত তৈরি করে। আবার এই আগস্টেই দেখা যায় ভয়াবহ বন্যা। সেই বন্যার মোকাবিলায় তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেশের জন্য এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারুণ্য প্রমাণ করেছে যে, দেশের জন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তাদের এই সংগ্রাম কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং একটি আত্মনির্ভরশীল, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দারুণভাবে আমাদের উদ্দীপিত করছে।
গ্রিক পুরাণের বীর হেরাক্লিস যেমন অদম্য মানসিক শক্তি ও সাহসিকতার মাধ্যমে তার দেশকে সুরক্ষা দিয়েছিল, তেমনই বাংলাদেশের ছাত্ররা নিজেদের দেশকে নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই নতুন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তারা কেবল রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; তারা এখন দেশের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কাজ করছে। আমরা দেখেছি কিভাবে দিনরাত পরিশ্রম করে পুলিশবিহীন একটি সময়ে তারা দেশের সমগ্র রাজপথের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে।
ছাত্ররা নতুন প্রজন্ম, নতুন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে চায়, কাজের মাধ্যমে নিজেদের সামনে এগিয়ে নিতে চায়। তারা কৃষিক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিত্যনতুন সমাধান বের করতে চায়। বিশেষ করে, বন্যার পরে দ্রুততার সঙ্গে পুনরুদ্ধার কাজের জন্য তারা বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি এবং মডেল তৈরি করেছে যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য বিশাল উপকার বয়ে আনবে। আমরা দেখেছি, ছাত্ররা আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যাদুর্গত এলাকার মানচিত্র তৈরি করেছে, যা পুনরুদ্ধার কাজকে দ্রুত ও কার্যকরী করতে সহায়তা করেছে। সোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে জেন-জিরা দারুণ সব চমক দিয়েছে আমাদের।
শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশে মেধাভিত্তিক চাকরি ব্যবস্থার নতুন পথ চালু হচ্ছে। তরুণেরা নিজেদের জন্য মেধাভিত্তিক চাকরির সুযোগ তৈরি করতে এক বিশাল পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি করেছে। আগে যেখানে চাকরি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব বা পারিবারিক পরিচয়ের গুরুত্ব ছিল বেশি, সেখানে এখন মেধা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া যাবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আরও উদ্যমী ও উৎসাহী হয়ে উঠছে, কারণ তারা জানে যে তাদের পরিশ্রম এবং মেধা এখন মূল্যায়িত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হিসেবে ভবিষ্যতে কাজ করার নতুন সুযোগ তৈরি করতে পরামর্শ দিতে চাই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণের চমক দিয়ে সাম্যের পৃথিবী তৈরির স্বপ্ন দেখছে। তার দেখানো পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে স্টার্টআপ কালচার দিন দিন বাড়ছে, যেখানে তরুণরা নিজেদের নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে এবং নতুন ব্যবসা শুরু করছে। তরুণদের এই কাজকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে তে হবে। এই উদ্যোগগুলোর পেছনে ছাত্রদের মেধা এবং উদ্ভাবনী চিন্তার অবদান রয়েছে। তারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করছে এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করছে। ফলে, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে তরুণদের অংশগ্রহণের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি করা। আমরা জানি, দেশের প্রকৃত উন্নয়ন এবং অগ্রগতির জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তাই, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ নিতে হবে। ডজনে ডজনে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি না করে, গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে। স্থানীয় সমস্যা স্থানীয় উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ছাত্ররা অনেক গবেষণা প্রজেক্টে কাজ করছে, সেগুলোর ফলাফল দেশের কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং প্রযুক্তি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তার জন্য বিনিয়োগ ও কারিগরি সহযোগিতা দিতে হবে।
প্রবাসী মেধাবী বাংলাদেশীদের কাজের সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে আমরা নতুন বিপ্লবকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারি। দেশের উন্নয়নে তাদের অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হওয়ায়, প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের মেধা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে বলে আশা করছি। দেশের বাইরে থাকা মেধাবী ছাত্ররাও দেশে ফিরে আসতে চান, তারা দেশের বিভিন্ন খাতে তাদের মেধা ও দক্ষতা প্রয়োগ করতে আগ্রহী। এমন সুযোগ পেলে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের ছাত্রদের এই সংগ্রাম কেবল একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, যেখানে মেধা, উদ্ভাবনী চিন্তা, এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে। তাদের এই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। রূপান্তরিত এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা।
এই বিপ্লবের পর, বাংলাদেশের ছাত্ররা যে মেধা ও মননের পরিচয় দিয়েছে তা কেবল একটি জাতির পুনরুজ্জীবনের গল্প নয়, বরং তা দেশের অগ্রগতির নতুন ধারার সূচনা। তারা প্রমাণ করেছে, দেশের জন্য সত্যিকার ভালোবাসা এবং ত্যাগের মানসিকতা থাকলে কোনো প্রতিকূলতাই তাদের অগ্রগতির পথকে থামিয়ে রাখতে পারে না। তাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রযুক্তিগত নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তাদের এই সংগ্রাম কেবল একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনীর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে। তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যেখানে শিক্ষা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি একসঙ্গে কাজ করে দেশের অগ্রগতির পথকে প্রশস্ত করবে।
ছাত্ররা জানে যে, শুধুমাত্র স্বাধীনতা অর্জনই যথেষ্ট নয়; দেশের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। তাই, তাদের জন্য উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপ কালচারকে উৎসাহিত করতে হবে, এতে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী হবে। এর পাশাপাশি, মেধাভিত্তিক চাকরি ব্যবস্থার বিকাশ, গবেষণার পরিবেশ তৈরি এবং প্রবাসী মেধাবীদের কাজের সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে তারা দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করছি।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ছাত্ররা কেবল একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে মেধা, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং সামাজিক প্রগতি একসঙ্গে কাজ করবে।
লেখক: নাফিসা নাজীন লুৎফা, প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রোফেশনালস