×

মুক্তচিন্তা

শিশুশিক্ষায় বিপ্লব: প্রয়োজন আধুনিক সংস্কার

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০০ পিএম

শিশুশিক্ষায় বিপ্লব: প্রয়োজন আধুনিক সংস্কার

শিশুশিক্ষায় বিপ্লব: প্রয়োজন আধুনিক সংস্কার

   

বিশ্বজুড়ে শিশুশিক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যায়, যা প্রত্যেক দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে সব দেশেরই একটি সাধারণ লক্ষ্য থাকে—শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যা তাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক। ফিনল্যান্ড, জাপান, এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে, যাতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারে।

এখন প্রশ্ন, আমরা কিভাবে শিশুশিক্ষার মান সম্পন্ন করব—মুখস্থ করে শেখা, করা থেকে শেখা নাকি দেখা থেকে শেখা?

শিশুরা সাধারণত করা থেকে শেখা (hands-on learning) পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করে। শিশুরা যখন নিজেরা হাতে কাজ করে শিখে, তখন তারা শুধু তত্ত্বগত নয়, বরং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান করতেও দক্ষ হয়।

অন্যদিকে, দেখা থেকে শেখা (observation-based learning) শিশুরা তাদের পরিবার, সমাজ এবং আশেপাশের ব্যক্তিদের থেকে কীভাবে আচরণ করে তা শিখতে পারে। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শিক্ষা পদ্ধতি, কারণ শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবেশের আচরণগুলো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। দুর্নীতি, অসততা, এবং নেতিবাচক আচরণ শিশুদের সামনে যখন প্রদর্শিত হয়, তখন তারা সহজেই সেটিকে গ্রহণ করে এবং সেটাকে সঠিক বলে মনে করতে শুরু করে।

তাছাড়া মুখস্থ শেখা একটি প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগত বিষয়গুলো মুখস্থ করতে বাধ্য হয়। তবে, এই পদ্ধতি বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয়।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীতে সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এখানে শিশুরা স্বাধীন চিন্তা করতে এবং সৃজনশীল হতে উৎসাহিত হয়। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর ওপর পরীক্ষার চাপ কমিয়ে দিয়ে, প্রকৃতির মধ্যে শিখতে দেয়। শিশুদের কৌতূহল এবং স্বাধীনতা দিয়ে তাদের শেখার ইচ্ছাকে উসকে দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিশুরা ক্লাসরুমের বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিখতে পারে, এবং তারা নিজেদের আগ্রহ অনুযায়ী শেখার বিষয় বেছে নিতে পারে।

জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে ফিনল্যান্ডের বিপরীত হলেও সমানভাবে কার্যকর। সেখানে শিশুদের প্রাথমিকভাবে শিষ্টাচার, সামাজিক দায়িত্ববোধ, এবং সম্মানের বিষয়গুলো শেখানো হয়। নৈতিক শিক্ষা জাপানের স্কুলগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে ও স্কুলে শৃঙ্খলা মেনে চলে, যা পরবর্তী জীবনে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি করে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে।

মন্টেসরি পদ্ধতি শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে আরেকটি দারুণ উদাহরণ। এখানে শিশুরা স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করতে শিখে, এবং শেখার পুরো প্রক্রিয়াটি তাদের কৌতূহল এবং স্বাভাবিক বিকাশের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই পদ্ধতিতে শিশুরা নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরে গিয়ে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ পায়, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীলতা উন্নত করে।

সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থায়, ফিনল্যান্ডের মতোই, শিশুদের উপর পরীক্ষার চাপ কম এবং স্বাধীন চিন্তা এবং সৃজনশীলতা বিকাশের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা প্রকৃতির মাঝে শিখতে পারে, এবং তারা স্কুলে এমন পরিবেশ পায় যেখানে খেলাধুলা, প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সমন্বিতভাবে ঘটে। এখানে শিশুরা নিজেদের গতিতে শিখতে পারে এবং নিজেদের প্রাকৃতিক কৌতূহল অনুসরণ করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

সুইডেনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি বিশেষত্ব হলো প্রাথমিক পর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পরীক্ষার চেয়ে শিশুদের মধ্যে সততা, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা দেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারে, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা এখনও সনদ এবং পরীক্ষার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।

বাংলাদেশে মুখস্থ শেখা একটি প্রচলিত পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগত বিষয়গুলো মুখস্থ করতে বাধ্য হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পরীক্ষা এবং সনদনির্ভরতা। একইসাথে শিশুরা তাদের পরিবার, সমাজ এবং আশেপাশের ব্যক্তিদের থেকে কীভাবে আচরণ করে তা শিখতে পারে। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শিক্ষা পদ্ধতি, কারণ শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবেশের আচরণগুলো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। দুর্নীতি, অসততা, এবং নেতিবাচক আচরণ শিশুদের সামনে যখন প্রদর্শিত হয়, তখন তারা সহজেই সেটিকে গ্রহণ করে এবং সেটাকে সঠিক বলে মনে করতে শুরু করে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সামাজিক দুর্নীতি ও অশুভ প্রভাব প্রচলিত, সেখানে শিশুদের এই ধরণের শেখা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়, দুর্নীতি, অসততা এবং নৈতিক অবক্ষয় একটি বড় সমস্যা। শিশুদের চারপাশের পরিবেশ যখন দুর্নীতি দ্বারা প্রভাবিত, তখন তারা সেই নেতিবাচক প্রভাবের অংশ হয়ে ওঠে। **দেখা থেকে শেখা** তাদের জন্য একটি নেতিবাচক শিক্ষার পদ্ধতিতে পরিণত হয়। তারা মনে করে, অসততা এবং অনৈতিক আচরণ জীবনের স্বাভাবিক অংশ, যা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

শিশুদের মানসিক এবং নৈতিক বিকাশে যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হয়, তবে শিক্ষার পাশাপাশি সমাজকেও নৈতিকভাবে উন্নত হতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যা শিশুরা তাদের পরিবার, স্কুল এবং সমাজের মাধ্যমে শিখতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ শিশুদের মধ্যে শুরু থেকেই গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতিমুক্ত এবং নৈতিকভাবে সঠিক সমাজের অংশ হতে পারে।

ভবিষ্যতের পরিকাঠামোর জন্য ফিনল্যান্ড, জাপান, এবং সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থার উদাহরণ থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি, তা হলো: শিক্ষাকে একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, শিশুদের সৃজনশীলতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সমন্বয় করে শেখানো দরকার।

বাংলাদেশে শিশুশিক্ষার উন্নয়নে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যা নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে হবে।

নিচে বাংলাদেশের জন্য কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো:

১. শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব:

- শিশুরা যাতে সৎ, আদর্শ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে, সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরিবার, স্কুল এবং সমাজে এই শিক্ষা প্রচলিত হলে শিশুরা দুর্নীতির প্রভাব থেকে দূরে থাকবে।

২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন:

- শিশুদের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দেওয়া এবং সততার মূল্যবোধ শেখানো গুরুত্বপূর্ণ।

৩. প্রকৃতি এবং খেলাধুলার মাধ্যমে শেখা:

- সুইডেনের মতো শিশুরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে এবং খেলার মাধ্যমে শেখার সুযোগ পেতে পারে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। এটি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক হবে।

৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন:

- শিক্ষকরা যেন শুধুমাত্র পাঠদাতা না হয়ে শিশুদের মেন্টর হিসেবে কাজ করতে পারে, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন করতে হবে। শিক্ষকরা যদি নৈতিক শিক্ষা এবং সৃজনশীল শেখার পদ্ধতি জানেন, তবে তারা শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে সক্ষম হবেন।

৫. প্রযুক্তি ও হাতে কলমে শেখা পদ্ধতির সমন্বয়:

- শিক্ষায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং hands-on learning পদ্ধতি যুক্ত করা দরকার। শিশুরা প্রযুক্তি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারে, সেটি শেখানো উচিত।

এ ছাড়া, যারা এই শিক্ষা দানের কারিগর, অর্থাৎ শিক্ষকরা, তাদের যদি নৈতিকতা এবং শিক্ষাদানের মৌলিক তত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকে, তাহলে সঠিক শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়। সুতরাং, শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিদিনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে কী শিক্ষা প্রয়োজন, কেন তা প্রয়োজন এবং কিভাবে তা প্রদান করা হবে।

শুধুমাত্র তখনই শিশুরা সত্যিকার, সুষ্ঠু ও সঠিক শিক্ষা পাবে, যা তাদেরকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এভাবে, শিশুশিক্ষার মাধ্যমে একটি উন্নত, নৈতিক এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App