কেন ছোড়ভঙ্গরা করছে ছোটাছুটি?

ড. মো: মঞ্জুর মওলা, ফিনল্যান্ড থেকে
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৮ এএম

ড. মো: মঞ্জুর মওলা, সমাজ বিজ্ঞানী, টেকসই রিনিউবল এনার্জি ও সার্কুলার অর্থনীতি এক্সপার্ট
ইতিহাসের ভাঁজেও চাপা পড়েছে অনেক শ্লোগান ও ছবির কথা। রাজনীতিতে স্লোগানের যেমন আছে নিজস্ব ভাষা ও অর্থ; ঠিক তেমনি ছবিরও আছে নিজস্ব একটা ভাষা ও অর্থ। স্লোগান ও ছবির ভাষা ও অর্থকে বোঝার মত সক্ষমতা অনেকের নেই। তাই ছোড়ভঙ্গরা করছে ছোটাছুটি! প্রশ্ন জাগে, ছোড়ভঙ্গরা কারা, কী এদের পরিচয়? নাকি এরা রাজনীতির স্লোগান ভুলে শুধু ছবি নিয়ে করছে ছোটাছুটি? কিন্তু কেন? প্রিয় পাঠক, এই প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে আজকের নিবন্ধ।
এক
১৯৭৫ সাল। তৎকালীন সমাজের বেশকিছু নমস্য ব্যক্তিবর্গ নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিল করার জন্য ভিন্ন পরিচয়ে নিজেদের চিহ্নিত করতে সদা ব্যস্ত ছিলেন। যেমন রাজনীতি-কূটনৈতিক ঘরনায় উচ্চ পদের মানুষ আবুল ফজল সাহেব। সাহিত্যিক আহমদ ছফার মতে ‘যিনি সারাজীবন নাস্তিকতার পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে না আসতেই একটি ভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে চিহ্নিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন’। বর্তমানে আবুল ফজল সাহেবদের মতো লোকেরাই ‘ছোড়ভঙ্গরা’।
আসুন আরো একটু দেখে নেওয়া যাক কোন ধরনের চরিত্রের অধিকারী ছোড়ভঙ্গরা। এরা ছন্দানুবর্তন ও বিশ্ববন্দিত প্রতারক শ্রেণীভুক্ত। অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফ্রাঙ্ক উইলিয়াম আ্যবাগনেল জুনিয়র চরিত্রের আদলে স্টিফেন স্পিলবার্গের বায়োপিক ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ ছবির গল্পের মতো।
এছাড়া পল্লবগ্রাহী, রাজনীতিজ্ঞ ও বেশভূষায় নিখুঁত এই ছোড়ভঙ্গরা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক দলের ছদ্মবেশে ভরে যাবে বাংলার রাজপ্রাসাদ। হয়তো এ কারণে বর্তমানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে ছোড়ভঙ্গদের ছোটাছুটির চাপে রাজনৈতিক অঙ্গন ভুলতে বসেছে, পতিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যবহৃত অনেক রুচিসম্মত যুগোপযোগী স্লোগান। উদাহরণ হিসেবে আমার এক বন্ধুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
২০২২ সাল। আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত। বন্ধু সাগর (ছদ্মনাম) দেখতে এসেছে আমাকে। বিদেশের কূটনৈতিক পাড়ায় আছে ওর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার মতো শ্রোতাকে পেয়ে বলেছিল- ‘‘স্বৈরশাসকের জন্য বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতিতে বেশকিছু রুচিহীন ও অসভ্য শ্লোগান ব্যবহার হচ্ছে। যা প্রতিনিয়ত আঘাত করছে আমাদের জাতীয়তাবোধকে। অন্যদিকে এখন দেশের সর্ববৃহৎ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যবহার করছে রুচিসম্মত স্লোগান ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। যুগোপযোগী এই স্লোগানের আছে তিনটি কম্পোনেন্ট: (১) গ্রোয়িং ইকোনোমি, (২) রিফরমিং পাবলিক সার্ভিসেস এবং (৩) রিইউনিং বাংলাদেশ। আর টেক ব্যাক বাংলাদেশ স্লোগানটিতে অর্থ, অভিব্যক্তি, ইচ্ছা, সত্য ও সঠিক দাবির প্রকাশ ঘটছে। তাই বিদেশী কূটনীতিক পাড়ায় বিএনপির আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগানের সাথে একমত পোষণ করছে’’।
প্রিয় পাঠক, রাজনীতিমনষ্ক বন্ধু সাগরের কথাগুলো মনে পড়লো বিধায় নিচের প্রশ্ন দুটি থাকলো আপনার কাছে।
২০২৪ সাল। আপনার আশেপাশে অদৃশ্য পতিত সরকার অশরীরীভাবে অবস্থান করছে বিধায়, (এক) রাজনৈতিক ছত্রপতিরা কি ভুলতে বসেছেন আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগানগুলো? নাকি (দুই) ছোড়ভঙ্গদের ছলচাতুরীর জালে পরে রাজনৈতিক ছত্রপতিরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে অনেকটা নাজেহাল? এ কারণেই কি বাকচাতুরী, বাকসর্বস্ব, বাক্যবাণ ওই ছোড়ভঙ্গদের কাছে শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক ছত্রপতিরা হতে চলেছে শ্রান্ত?
রাজনৈতিক ছত্রপতিরা আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগানগুলোর অর্থ, অভিব্যক্তি, ইচ্ছা, সত্য ও সঠিক দাবির কথা মনে রেখে, সে অনুযায়ী কাজ করাটা জরুরী। প্রসঙ্গত সমাজের কিছু নমস্য ব্যবসায়িকরা আবারও যেন সংসদ-রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলা শুরু করতে না পারে, এটাও মনে রাখাটা জরুরী। নতুবা ফিরে আসা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে চিরতরে!
দুই
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয় আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, ছোড়ভঙ্গরা এখন কি নিয়ে করছে ছোটাছুটি? এ প্রসঙ্গে দু’একটি কথা লেখা যেতে পারে।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ, উপজেলা ও জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে- মস্তিষ্কের রসায়ন যেমন একজন মানুষকে বুঝতে সহযোগিতা করে- অন্য মানুষটি কি করছে, কি ভাবছে ও কি করতে চায় ইত্যাদি। ছোড়ভঙ্গরা তেমন মানুষের সাথে কৃত্রিম সুসম্পর্কের রসায়ন সৃষ্টি করার জন্য, এখন ‘ছবি নিয়ে করছে ছোটাছুটি’। প্রশ্ন জাগে, কিসের ছবি বা কার ছবি নিয়ে করছে ছোটাছুটি? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে জানা যাক ছবির ভাষা কেমন।
১৩৭৫-১৪২৫ সালের দিকে প্রথম ইংরেজিতে ব্যবহৃত ছবি (পিকচার) শব্দটি শিল্পী রাসেল চৌধুরীর মতে, ছবি কথা বলে সুখ, দুঃখ, হাসি ও কান্নার। বলে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কষ্টের কথা।
কিন্তু ছবির ভাষা বুঝতে অক্ষম ছোড়ভঙ্গরা। তাই ওরা এখন দেশের বিভিন্ন বিষয়ে ছিন্নদ্বৈধ থাকার জন্য ব্যবহার করছে রাজনৈতিক ছত্রপতিদের ছবি। যেমন (১) বিএনপি নেতার হত্যার ঘটনা ভিন্ন দিকে নিতে কোম্পানীগঞ্জে দলের এক বড় নেতার ছবি দিয়ে গায়েবি পোস্টারিং (বিএনপির বিক্ষোভ, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪), (২) রাজনৈতিক ছত্রপতিদের ছবি ব্যবহার করে নীরবে-নিভৃতে দেশের সর্বক্ষেত্রে পরিচালনা করছে চাঁদাবাজি। (৩) মাঠে নীরব, অনলাইনে সরব ছোড়ভঙ্গরা রাজনৈতিক ছত্রপতিদের ছবি ব্যবহার করে, নতুন বাংলাদেশের দরবারে প্রবেশ করে, সংবিধান, নির্বাচন ও সংসদ সংস্কারতন্ত্র, উন্নয়নতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, গণতন্ত্রে-রাজ্যনীতি লিখতে সদা হন্তদন্ত এবং (৪) রাজনৈতিক ছত্রপতিদের ছবি ব্যবহার করে ছোড়ভঙ্গরা বড় বড় কথা বলে, সমাজে বাগ্মী সেজে বাকরোধ করতে চলেছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের।
নতুন বাংলাদেশে ছোড়ভঙ্গরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে থাকলে, আবারও অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটতে পারে কয়েকটি আন্দোলন। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭৫ সালে চিলির আন্দোলন, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলন কিংবা ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার আন্দোলন।
প্রসঙ্গক্রমে, খ্রিষ্টানদের মধ্যে ছোটাছুটির অর্থ বুঝতে না পারায় আল-আন্দালুসে ইসলামের স্বর্ণযুগে সাতশ সত্তর বছরের মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ১৪৯১ সালে। ১৯২৪ সালে প্রায় সাতশ বছরের বিশাল উসমানীয় (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। যার অন্যতম কারণ ছিল উসমানীয়-রাজ্যের শাসকদের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর ছোটাছুটির অর্থ বুঝতে না পারার সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের যুদ্ধমন্ত্রী ইসমাইল এনভারের নির্দেশে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবিন্যাসে অদূরদর্শিতা।
উপরের আলোচনা ও উদাহরণ পড়ে ফেরেজবাজ ছোড়ভঙ্গদের জলসা ঘরে জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টি করলেও করতে পারে। তবে নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছত্রপতিদের বাহ্যদৃষ্টি নয় বরং বাহ্যেন্দ্রিয়ের (পাঁচ ইন্দ্রিয়) মাধ্যমে উপরের উদাহরণ বুঝতে হবে অনেকটা এভাবে-
এক. রাজনৈতিক ছত্রপতিরা আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগানগুলোর অর্থ, অভিব্যক্তি, ইচ্ছা, সত্য ও সঠিক দাবির কথা মনে রেখে সে অনুযায়ী কাজ করাটা জরুরী কেন? দুই. ছোড়ভঙ্গরা রাজনৈতিক ছত্রপতিদের ছবি ব্যবহার করে নতুন বাংলাদেশের দরবারে প্রবেশ করে সংবিধান, নির্বাচন ও সংসদ সংস্কারতন্ত্র, উন্নয়নতন্ত্র বা গণতন্ত্রে-রাজ্যনীতি লিখতে কেন সদা হন্তদন্ত?
এই দুটি প্রশ্নের উত্তরের ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে পারলেই নতুন বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবারের ভাষায় বলতে হয় যে ‘রাজনৈতিক ছত্রপতিদের আছে নৈতিক মেরুদণ্ড এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। শুধু তাদের কর্নমহোদ্বয় শুনতে ও মস্তিষ্ক বুঝতে পারবে ‘কেন ছোড়ভঙ্গরা করছে ছোটাছুটি’।
লেখক: ড. মো: মঞ্জুর মওলা, সমাজ বিজ্ঞানী, টেকসই রিনিউবল এনার্জি ও সার্কুলার অর্থনীতি এক্সপার্ট, ইমেইল: [email protected]