অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস, সীমিত আয় এবং দুর্নীতির সম্পর্ক: কারণ ও সমাধান
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ পিএম

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
মানুষের জীবনে অভ্যাসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের বড় অংশই অভ্যাসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তবে, অভ্যাস যখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে কিংবা বদঅভ্যাসে রূপ নেয়, তখন তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, সীমিত আয় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে মানুষ আর্থিক সংকটে পড়ে। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই বেআইনি উপার্জনের পথ বেছে নেন, যা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
এই প্রতিবেদনে আমি বিশ্লেষণ করব, কীভাবে অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস ও সীমিত আয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এছাড়া, এসব সমস্যার সমাধানের পথ কী এবং কীভাবে একটি নৈতিক ও সুশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করা হবে।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস ও বদঅভ্যাসের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস বলতে বোঝায় এমন ব্যয় বা আচরণ যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং এড়ানো সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্যাশন ব্র্যান্ডে অতিরিক্ত খরচ, সামাজিক মর্যাদার দোহাই দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন, কিংবা প্রযুক্তিপণ্যে আসক্তি। অন্যদিকে, বদঅভ্যাস হলো এমন আচরণ যা মানুষ সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, যেমন ধূমপান, অ্যালকোহল বা লটারির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যয়।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন সীমিত আয়ের সঙ্গে খরচের সামঞ্জস্য বজায় থাকে না, তখন এটি আর্থিক সংকট সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে অনেকেই ব্যয়বহুল স্মার্টফোন কেনা বা বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। এ ধরনের খরচ তাদের ঋণগ্রস্ত করে তোলে। পারিবারিক বাজেট ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পারিবারিক জীবনে মানসিক চাপ বাড়ায়, যা সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
পারিবারিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় আয়োজনের প্রতিযোগিতা যেমন আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে, তেমনই পরিবারে হতাশা, দোষারোপ এবং মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একইসঙ্গে সমাজে ভোগবাদী মনোভাবের প্রসার ঘটে, যা আরও বেশি খরচ করার চাপ সৃষ্টি করে।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের চাপে পড়ে অনেকেই বেআইনি পথে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেন। সীমিত আয়ের মানুষ যখন অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হন, তখন দুর্নীতির পথে পা বাড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের চাপ দুর্নীতির প্রবণতা বাড়ায়।
মানসিক চাপ এবং হতাশা মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে। আর্থিক সংকটের কারণে সৃষ্ট মানসিক অস্থিরতা দুর্নীতি ও অসততার পথ সুগম করে। ব্যক্তিগত স্তরে এটি আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, কাজের প্রতি অনীহা এবং সম্পর্কের অবনতির কারণ হয়।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয় শুধু ব্যক্তিগত সংকট সৃষ্টি করে না, বরং এটি সমাজের নৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে। এই প্রবণতা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায় এবং সামাজিক অস্থিরতা ও আস্থাহীনতা বাড়ায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আয় মৌলিক চাহিদা পূরণেও যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে বিলাসবহুল জীবনধারা রক্ষার চেষ্টায় অনেকেই বেআইনি উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং কঠোর শাস্তির অভাবে বেআইনি আয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে।
কর্মসংস্থানের অভাবও একটি বড় কারণ। তরুণ প্রজন্ম বেকার থাকায় এবং পারিবারিক চাপ সামলাতে বেআইনি পথে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখার প্রতিযোগিতা এবং আর্থিক সংকট দুর্নীতির প্রলোভনকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্নীতি দেশের উন্নয়নকাজে বাধা সৃষ্টি করে, সরকারি তহবিলের অপচয় ঘটায় এবং বিদেশি বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে ভোগে।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস এবং সীমিত আয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা দুশ্চিন্তা ও দুর্নীতি হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমনে কঠোর এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একটি উপযুক্ত বেতন কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতির প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে পারেন। পাশাপাশি, দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করাই হবে সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস পরিহারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, মিতব্যয়িতা এবং নৈতিকতার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে গণমাধ্যম, স্কুল, কলেজ এবং স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে কর্মশালা ও প্রচারণা চালানো উচিত। পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে মানুষ সচেতনভাবে তাদের খরচের ধরন পরিবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার চর্চা করা অপরিহার্য। ব্যাংক এবং মাইক্রো-ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো বাজেটিং টুলস এবং আর্থিক পরিকল্পনার প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারে। পাশাপাশি, উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা, প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, যা দুর্নীতির প্রবণতা কমাতে সহায়ক হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রযুক্তি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। এছাড়া, সরকারি সেবাগুলো সহজলভ্য করার জন্য অনলাইন সেবা চালু করা এবং এর মাধ্যমে দালালচক্র ও দুর্নীতির সুযোগ কমানো যেতে পারে।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়াতে মানুষকে ন্যূনতম চাহিদার ধারণা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাজেটিং টুলস এবং মাইক্রো-সেভিং কার্যক্রম ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খরচ পরিচালনা করা যেতে পারে। বিজ্ঞাপন ও বিপণন খাতে মিতব্যয়িতার বার্তা ছড়িয়ে মানুষকে অতিরিক্ত ব্যয় থেকে বিরত রাখতে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস এবং দুর্নীতির সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী, তাই এর সমাধানেও দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক এবং কার্যকর কৌশল বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে এবং সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক নিরাপত্তার সংকট তৈরি করছে। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। দুর্নীতির প্রতি মানুষের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর সমাজে “গ্রহণযোগ্যতা” একটি গুরুতর সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধ এবং শিক্ষার অভাব দুর্নীতির প্রসারের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে।
সিঙ্গাপুর দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে একটি সফল উদাহরণ। কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় রেখে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সেখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা দুর্নীতি দমনের জন্য একটি মডেল হতে পারে। রুয়ান্ডাও কঠোর নীতিমালা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্যোগ এবং ই-গভর্নেন্স প্ল্যাটফর্মের প্রসার ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। তবে এই প্রচেষ্টাগুলো আরও কার্যকর করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইন প্রয়োগের প্রয়োজন।
অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস এবং সীমিত আয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য একটি সমাজের নৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। দুর্নীতি ও অস্থিরতার মতো সমস্যা ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি, নৈতিক শিক্ষা, বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- আপনি নিজে কতটুকু মিতব্যয়ী? আপনার পরিবারে সঠিক বাজেটিং চর্চা করা হয় কি?
- আপনি কীভাবে নিজেকে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে পারেন?
দুর্নীতির মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুধু সরকারের কাজ নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব। ব্যক্তিগত সততা, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুশাসিত, নৈতিক এবং টেকসই সমাজ গঠন সম্ভব। এটি কেবল সমাজের উন্নতি নয়, দেশের সমৃদ্ধির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বশেষে, সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও নৈতিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের এই সংগ্রামকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে, যাতে প্রতিটি পদক্ষেপে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা এবং সুশাসনের উন্নতি হয়। তবে এটি সম্ভব, যদি আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সততা বজায় রাখি এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করি। কারণ সততা হচ্ছে সমাজের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী বিনিয়োগ।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]